UsharAlo logo
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সরকারি হাসপাতালের লিফট যেন মরণফাঁদ

usharalodesk
এপ্রিল ৩, ২০২৪ ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের লিফটগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। লক্কড়ঝক্কড় এসব লিফটে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বছরখানেক আগেও লিফটে আটকা পড়ে এবং নিচে পড়ে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিটউট ও হাসপাতালে এক রোগীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুদিন পর সেই লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপরও বেশির ভাগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। এর মধ্যে সম্প্রতি আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনসহ উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা আটকা পড়েছিলেন জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে।

সূত্র জানায়, ৩১ মার্চ আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা এক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসক-কর্মকর্তা হাসপাতালের দশতলা থেকে ডক্টরস লিফটে নিচে নামার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে মন্ত্রী চরম উষ্মা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এমন অপ্রীতিকর ঘটনায় হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ গণপূর্ত বিভাগে (ইএম বিভাগ) চিঠি দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলছেন। ওই চিঠির একটি কপি হাতে এসেছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ‘অগ্নিঝরা মার্চ: বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। মন্ত্রীর অনুষ্ঠানের বিষয়ে লিফটের ফিটনেস পরীক্ষায় গণপূর্ত ইএম বিভাগের সংশ্লিষ্ট সব প্রকৌশলীকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল। এরপরও কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে এমন ঘটনা ঘটেছে। এতে তার প্রতিষ্ঠানের (নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল) সার্বিক অর্জন ও সুনাম মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘যে কোনো যন্ত্রের ক্ষেত্রেই মেকানিক্যাল ফল্ট (যান্ত্রিক ত্রুটি) যে কোনো সময় হতে পারে। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। ওই ঘটনায় আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে।’

তিনি বলেন, সব মেকানিক্যাল যন্ত্রের নির্দিষ্টি ‘টাইম ফ্রেম’ থাকে। সেদিকে সবার সচেতন থাকা দরকার। হাসপাতালসহ প্রতিটি ভবনের লিফটে সব সময় অপারেটরের উপস্থিতি থাকতে হবে। কখন কোথায় কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটে, বলা মুশকিল। লিফট, এসিসহ বিদ্যুৎচালিত সব ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়মিত সার্ভিসিং করাসহ সংশ্লিষ্টদের মনিটরিং করা উচিত।

সূত্র জানায়, সাধারণত ভবন নির্মাণের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার লিফট সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কৌশলে নিুমানের লিফট সরবরাহ করা হয়। এখানে বড় ধরনের কমিশন ভাগাভাগির দুর্নীতির অভিযোগ প্রবল। কিন্তু জনৈক প্রভাবশালী নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগের এই জোনে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করলেও এসব অনিয়মের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি।

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ঘটনায় একাধিক সরকারি হাসপাতালে সরেজমিন গিয়ে সেখানে হাসপাতালের লিফটগুলো অনেক পুরোনো ও জরাজীর্ণ দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিফটগুলো চলার সময় ভয়ংকর শব্দ হয়, মাঝেমধ্যে আটকে যায়। দরজা খোলা থাকে আবার বন্ধ হলে খুলে না। ওঠানামা ও দরজার সুইচগুলো (সেন্সর বোতাম) ঠিকমতো কাজ করে না। নিচে ও উপরে ওঠানামার জন্য চিৎকার করে অপারেটরকে ডাকতে হয়। সংকেত চিহ্নগুলো নষ্ট। ফলে লিফটে আন্দাজমতো ওঠানামা করতে হয়। বিশেষ করে নষ্ট লিফট ব্যবহার করতে গিয়ে রোগীদের অনেক কষ্ট হচ্ছে।

শেরেবাংলা নগর এলাকায় আটতলাবিশিষ্ট জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে লিফটের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আখতার হোসেন অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে হাসপাতালের টেকনিশিয়ান কুতুবুল আলম ও লিফট অপারেটর মিল্লাত হোসেন বলেন, এখানে মোট ৬টি লিফট রয়েছে। দেশীয় লিফট সরবরাহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ৩টি, ড্যাফোডিল ১টি এবং স্পিড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজি ২টি লিফট সরবরাহ করেছে।

এর মধ্যে নিচতলার গ্যারেজ এবং ৬ নম্বর গেটের পাশে ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্সের একটি লিফট বসানোর পর থেকে ফ্লোরে পানি ওঠা বন্ধ রয়েছে। বেশ কয়েকবার মেরামত করা হলেও সেটি ব্যবহার উপযোগী করা যায়নি। আর স্পিড ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজির লিফট দুটির বয়স প্রায় ২০ বছর। প্রায় সময় আটকে যায় ও শব্দ হয়, সেন্সর ঠিকমতো কাজ করে না, দরজা ঠিকমতো লাগে না। ফলে ব্যবহারকারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। লিফট সরবরাহকারীদের একাধিকবার বলা হয়েছে। তারা এসে দেখে যান, মেরামত করেন; কিন্তু সমস্যা দূর হয় না।

শেরেবাংলা নগর এলাকায় অধিকাংশ হাসপাতালে লিফট সরবরাহ করেছে বেসরকারি লিফট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।’ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হোসেন বলেন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে আমাদের লিফট আছে। মন্ত্রী মহোদয় যে লিফটে আটকা পড়েছিলেন, সেটি আমাদের নয়। আমাদের লিফটে দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই আমি জানতাম। সেটি হয়তো অন্য কোম্পানির। আর কিডনি ইনস্টিটিউটের অকেজো লিফটের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে জায়গাতেই সমস্যা। বেশ কয়েকবার মেরামত করার পরও পানি উঠছে। তিনি দাবি করেন, আমাদের লিফট সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা। লিফটের সার্ভিস বেশ ভালো। আমরা সেফটি নিশ্চিতের চেষ্টা করি। কিন্তু দেশে বিদ্যুৎবিভ্রাট ও লিফটে প্রচুর ময়লা জমে। ব্যবহারকারীরাও সঠিক নিয়মে ব্যবহার করে না। ফলে মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।

পাশেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে মোট সাতটি লিফটের মধ্যে সচল ৬টা, একটা অচল রয়েছে। এই হাসপাতালেও ক্রিয়েটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ৩টি, মান বাংলাদেশ ১টি ও ড্যাফোডিল কোম্পানি ২টি লিফট সরবরাহ করেছে। হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কমর্চারী ছাড়াও রোগী ও স্বজনরা অভিযোগ করেন, লিফটগুলো চললেও মাঝেমধ্যে থেমে যায়। এক ফ্লোর থেকে আরেক ফ্লোরে থামে না। তখন আতঙ্কে পড়তে হয়। তাছাড়া হাসপাতালে ২০ জনের মতো লিফট অপারেটর থাকলেও কেউই লিফটের ভেতর থাকেন না।

হৃদরোগ হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহমুদুজ্জামান বলেন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরপর একটি লিফট প্রতিস্থাপন করা হয়। সেটির বয়স হলেও নষ্ট নয়। ভবনের ভার্টিক্যাল এক্সটেনশনের জন্য আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকি ৬টি ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বসানো হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র কমবেশি সমস্যা হতেই পারে। তবে দেখভালের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের লিফট অপারেটর রয়েছে।

চিকিৎসকরা আরও বলেন, প্রায় ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চারতলা বিশিষ্ট ৪১৪ শয্যার হাসপাতালটি এখন আটতলা করে ১২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। পুরোনো ভবনগুলোর ফ্লোর অনুপাতে লিফটগুলোর ক্যাপাসিটি অনুযায়ী যেভাবে স্থাপন করার কথা, তা করা হয়নি। বর্তমানে আটতলার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে লিফটগুলোকে এক্সটেনশন করা হলেও সেগুলো যুগোপযোগী নয়। অন্যদিকে শয্যা বাড়ায় রোগী ও স্বজন বেড়েছে। ফলে লিফটগুলোয় ঝুঁকি রয়ে গেছে। এজন্য ক্যাপসুল লিফট প্রতিস্থাপনের জন্য ভাবা হচ্ছে।

এছাড়া জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) নতুন ভবনের একটি লিফট থামানোর পর ফ্লোর ছেড়ে প্রায় আধা হাত নিচে ঠেকে। ফলে হাত-পা ভাঙা রোগীরা প্রায় সময় লিফটে উঠে নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়েন। এ বিষয়ে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎক-কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউই রাজি হননি। হাসপাতালের পিডব্লিউডি (গণপূর্ত বিভাগ) অফিস কক্ষে গিয়ে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। একইভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে সেখানেও লিফটের সমস্যা ও রোগীদের দুর্ভোগের তথ্য পাওয়া গেছে।

ঊষার আলো-এসএ