UsharAlo logo
মঙ্গলবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২০১৪ সালে ম্যাজিকের মতো বেড়ে যায় নানক ও তার স্ত্রীর সম্পদ

usharalodesk
অক্টোবর ১৯, ২০২৪ ৪:৩২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট :  আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু নার্গিসের সম্পদ ২০১৪ সালে ম্যাজিকের মতো বেড়ে যায়।  নানকের তুলনায় তার স্ত্রীর সম্পদ বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়।  ২০০৮ সালে আরজুমান্দ বানুর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪ টাকা, যা ২০১৪ সালে বেড়ে ৪ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার ১৭৯ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, নানকের সম্পদ ছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ ২১ হাজার ৪০২ টাকা।

নানক ও তার স্ত্রীর আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।  এই দম্পত্তির দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে তাদের সম্পদ অর্জনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্পদের এই বিশাল বৃদ্ধি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

এমপি হওয়ার পর ১৫ বছরে ৩০ গুণ সম্পদ বেড়েছে কবির নানকের। এটা অবশ্য কেবলই তার আয়করের হিসাবে। এর বাইরেও তার বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য মিলেছে রাজধানী ঢাকা, বরিশাল ও কক্সবাজারে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, কম করে হলেও শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য। যার বিরুদ্ধে এরইমধ্যে রাজধানী ঢাকা ও বরিশালে হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টার একাধিক মামলা হয়েছে। আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই পলাতক তিনি। যে কারণে নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি তার সঙ্গে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়েও নেওয়া যায়নি কোনো বক্তব্য।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান জাহাঙ্গীর কবির নানক। সেসময় এই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মন্ত্রণালয়ে খুব একটা যেতেন না আশরাফ। দায়িত্ব পালনে তার উদাসীনতা ও গাফিলতির ফলে সবকিছুর দেখভাল করতেন প্রতিমন্ত্রী নানক। আর এই সুযোগ বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। দায়িত্ব পালনের ৫ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। টেন্ডার থেকে শুরু করে বরাদ্দসহ মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় উন্নয়ন কাজে তাকে পার্সেন্টিজ দেওয়ার আলোচনা ছিল সর্বত্র।

এই আলোচনার প্রমাণ মেলে নানকের সম্পদ বৃদ্ধির গতিতে। ২০০৮ সালে দাখিল করা হলফনামায় ৩৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯৭ টাকার সম্পদ থাকার হিসাব দেন তিনি। সেসময় ব্যবসা ও কৃষি থেকে ২ লাখ টাকা দেখান বাৎসরিক আয়। দাখিল করা হলফনামায় স্ত্রীর নামে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪ টাকার সম্পদ থাকার তথ্যও দেন নানক। দুজনের মিলিয়ে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫১ টাকার।

২০১৪ সালে এসে ম্যাজিকের মতো বেড়ে যায় এই সম্পদের হিসাব। ১০ গুণ বেড়ে তাদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৫৮১ টাকায়। এক্ষেত্রে অবশ্য নানকের চেয়ে তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু নার্গিসের সম্পদের পরিমাণ বাড়ে বেশি। ২০০৮ সালে যেখানে স্ত্রীর সম্পদ ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪ টাকার, সেখানে ২০১৪ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার ১৭৯ টাকায়। এক্ষেত্রে নানকের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ ২১ হাজার ৪০২ টাকা। সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হিসাবে স্ত্রীর চাকরি, নিজের ব্যবসা, মৎস্য খামারের আয় দেখানো হলেও এই দম্পত্তির দৃশ্যমান যেসব আয় তার সঙ্গে সম্পদ অর্জনের কোনো মিল খুঁজে পায়নি কেউ। নানকের স্ত্রী আরজুমান্দ বানু একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। ২০১৪ সালে দাখিল করা হলফনামায় তার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৪৮৬ টাকা।

৩০ গুণ সম্পদ বাড়ল ১৫ বছরে : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন নানক। তবে সেবার আর তা পাননি তিনি। ফলে সংসদের বাইরেই থেকে যান তিনি। এমপি না হলেও অবশ্য তখন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে প্রভাব আর প্রতাপ, দুটোই ছিল তার। এসবের ব্যাপক প্রয়োগও করতেন তিনি। যে কারণে সম্পদের পরিমাণও বাড়তে থাকে আপন গতিতে। এমপি না থাকলেও নানকের বিরুদ্ধে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বদলি বাণিজ্য ও নানা ইস্যুতে লবিং-তদবির প্রশ্নে পার্সেন্টিজ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। যার প্রমাণ মেলে ২০২৪’র নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর তার দাখিল করা হলফনামায়। এবার স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৫১ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দাখিল করেন নানক দম্পত্তি। এরমধ্যে নানকের ১২ কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৭ এবং তার স্ত্রীর ৬ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ৬২৪ টাকার সম্পদ দেখানো হয়। ২০০৮ সালে যেখানে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫১ টাকা সেখানে ২০২৪ সাল নাগাদ ১৮ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদ বেড়েছে তাদের। হলফনামার বিশ্লেষণেও প্রশ্নবিদ্ধ নানা চমক দেখিয়েছেন নানক ও তার স্ত্রী। ২০০৮ সালে যেখানে নানকের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ২ লাখ টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে তার আয় ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ টাকা দেখানো হয়।

হলফনামায় ঘাপলা, বহু সম্পদের তথ্য গোপন : তিন হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে বহু ঘাপলা। ২০০৮’র হলফনামায় কৃষি অকৃষি মিলিয়ে ২ একর ৬৫ শতাংশ জমির মালিকানা দেখান নানক। তখন অবশ্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আর কোনো স্থাপনার মালিকানা দেখাননি তিনি। উল্লেখ করা হয় লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে ১০ শতাংশ এবং উত্তরায় ৩ কাঠার প্লটের মালিকানা থাকার কথা। এর বাইরে যৌথ মালিকানায় ১০ একর জমির এক চর্তুথাংশের মালিক বলে তথ্য দেন হলফনামায়। প্রথম দুটি জমি তার কেনা বলে জানান তিনি। যৌথ মালিকানার জমি কোথায় কিংবা তিনি ছাড়া আর কে কে মালিক তার কোনো তথ্য দেননি তখন। ২০২৪ সালে এসে সম্পদের যে বর্ণনা দেন নানক তার সঙ্গে কোনো মিল নেই ২০০৮’এর হলফনামার। ২৪’র বর্ণনায় রাজধানীর উত্তরায় ৬ তলা বাড়ি, মোহাম্মদপুরে ৮ তলা বাড়ি, কক্সবাজারে জমি, জন্মস্থান বরিশালে দুটি বাড়ি, বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় ভূ-সম্পত্তি এবং মাছের খামার মিলিয়ে ২ একর ২২ শতাংশ জমি থাকার তথ্য দেন তিনি। এর পুরোটাই তার নিজের নামে এবং সিংহভাগ পৈতৃক সম্পত্তি বলে হলফনামায় লেখেন নানক। সেই সঙ্গে যৌথ মালিকানায় থাকা জমির তথ্য চেপে যান। ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং উত্তরায় থাকা ৮ ও ৬ তলা দুটি বাড়ির মূল্য নির্ধারণ প্রশ্নেও ঘাপলা করেন নানক। উত্তরায় ৬ তলা ভবনের মূল্য দেখানো হয় ৪ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ১৪৭ টাকা। ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৪০৩ টাকা মূল্য দেখানো হয় মোহাম্মদপুরের ৮ তলা ভবনের। ২০১৪ সালে দাখিল করা হলফনামায় যেহেতু এই দুটি ভবনের উল্লেখ ছিল না তাই ধরে নেওয়া যায় যে এগুলো পরে নির্মিত। সেই হিসাবে এসব জমির মালিকানা ও ভবন নির্মাণের মূল্য প্রদর্শন প্রশ্নে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী এই নেতার বিরুদ্ধে। একইভাবে বরিশালসহ অন্যান্য স্থানে তার মালিকানায় থাকা সম্পদ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এর বাইরে বহু সম্পদের তথ্য গোপন রাখার অভিযোগও রয়েছে নানকের বিরুদ্ধে। বরিশালের নবগ্রাম রোড এলাকায় রয়েছে নানক পরিবারের বিপুল ভূ-সম্পত্তি এবং প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স। যার উল্লেখ নেই তার আয়কর রিটার্নে। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বাবুগঞ্জ এলাকায় দোয়ারিকা সেতু সংলগ্ন ১০ একর জমির মালিকানার তথ্যও গোপন করা হয়েছে। বরিশালে গ্লোবাল ভিলেজ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা রয়েছে নানক পরিবারের। এছাড়া সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা ও পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে বিপুল আয়তনের জমিসহ বরিশাল ও ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাট ও জমি থাকার তথ্য গোপনের অভিযোগ রয়েছে নানক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।

ঊষার আলো-এসএ