UsharAlo logo
রবিবার, ১৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অন্তর্বর্তী সরকারের ‘সিদ্ধান্তের সীমা’ নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

ঊষার আলো রিপোর্ট
মে ১৮, ২০২৫ ৪:১০ অপরাহ্ণ
Link Copied!

দেশের নানা সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করলেও, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বেশ কিছু ব্যাপারে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি রাখাইনে মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের ব্যবস্থাপনায় দেওয়া, আইএমএফ-এর ঋণের জন্য এনবিআর বিলুপ্ত করাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের আরো কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট কতটুকু? সংস্কার ও নির্বাচনের বাইরে কী কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

করিডর ও বন্দর নিয়ে এরইমধ্যে রাজপথে প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়েছে কিছু রাজনৈতিক দল। ‘বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে সভা করা অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ না’, এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতবিনিময় সভায় যায়নি বিএনপি।

এছাড়াও আলোচনায় আছে কাতারকে বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া। সেন্ট মার্টিন নিয়ে কী হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগেই। প্রতিটা ক্ষেত্রেই সরকারের নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকলেও নানা রাজনৈতিক দল এসব ব্যাখ্যা মানতে নারাজ।

এপ্রিলের শেষ দিকে প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরের সময় তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, কাতারকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা । এজন্য কাতারকে আলাদা একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের এইসব কাজের ম্যান্ডেট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম মনে করেন, এই সরকার চাইলেই সব কিছু করতে পারে না।

অধ্যাপক আইনুল বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রুটিন ওয়ার্ক করে। তাদের প্রধান কাজ হলো নির্বাচন। এই সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতির সরকার এটা আমরা সবাই জানি। তারপরও তাদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যাওয়া উচিত।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে তুলনার ব্যাপারে একমত নন। তিনি ডয়চে ভেলে’কে বলেন, প্রত্যেকটা বিষয়ে এই সরকারের ম্যান্ডেট আছে। আপনাকে বুঝতে হবে এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার। এটা আগের তত্তাবধায়ক সরকারের মতো না। প্রত্যেকটা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট আছে।

চার ইস্যু নিয়ে বিতর্ক

রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের যে কয়টি সিদ্ধান্ত বা আলোচনা নিয়ে এখন বিরোধিতা তৈরি হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া, রাখাইনে মানবিক করিডোর, কাতারকে বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা করতে আহ্বান এবং সেন্ট মার্টিন নিয়ে অস্বচ্ছতা।

তারা বলছেন, এই বিষয়গুলোর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত আছে। সরকার এর কোনো বিষয়ই পরিস্কার করছে না। ফলে এ আরো সন্দেহ তৈরি করছে। আর এই সরকার কতটুকু করতে পারবে সেই সীমানা সম্পর্কেও তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।

প্রেস সচিব বলেন, এই সরকার যখন এসেছে তখন কি আপনারা কোথাও শুনেছেন যে তারা এসে শুধু এটা (নির্বাচন) করবে? হ্যাঁ, ডেমোক্রেসি রেস্টোর করা আমাদের সবচেয়ে বড় কাজগুলোর একটি। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যেকোনো সময় আমরা নির্বাচন করব। করে আমরা আমাদের কাজটা শেষ করে চলে যাব।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের এমন বক্তব্যকে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ‘ঔদ্ধত্বপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, তিনি মনে করছেন সবকিছু করা তার দায়িত্ব। আমি অনুরোধ করবো তিনি যেন তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। কারণ যেসব কাজের কথা বলা হচ্ছে ওগুলো করা ওনাদের দায়িত্ব না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আসলে প্রফেসর ইউনূস একজন ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি রাষ্ট্রকে নিয়ে ব্যবসা করতে চাইছেন। তিনি ক্রমান্বয়ে মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে রাষ্ট্রকে বিপজ্জনক অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, যেটি তার করা উচিত নয়।

তিনি বলেন, তার যে কাজ সেটি করা উচিত, সেটা হচ্ছে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নেওয়া।

ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর ১৩ মে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন নিয়ে মতবিনিময় করতে ১৯ টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সভায় ১৭টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যোগ দিলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) অংশ নেয়নি।

আমন্ত্রণ জানানোর পরও সভায় অংশ না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী তখন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমরা দেখছি ক্রমাগতভাবে দেশে বিনিয়োগ কমছে, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা নির্বাচন ও রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন। সেটির জন্য নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণা করে বিনিয়োগকারীদের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। অন্য কিছু করে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগের নামে এক ধরনের সার্কাস চলছে। এতে বরং বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।

সভায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আকাশ বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক সরকারের ধারাবাহিকতা জরুরি। বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা চান। সেই নিশ্চয়তা না পেলে তারা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনের পর বিদেশি বিনিয়োগের একটা হাইপ তোলা হয়েছিলো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগই কমছে। এর কারণ হচ্ছে এটা অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আসলে কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। তারা নিরাপত্তার কথাসহ আরো অনেক কিছু ভাববে, উদ্যোগ যত ভালোই হোক না কেন।

তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো উদ্যোগ নিতে চাইলে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে কথা বলার ওপর প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন তিনি। সেটা হলে কিছু আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে এরইমধ্যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। এই প্রতিবাদ আরো বাড়বে। এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমালোচনার মুখে পড়েবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে এফডিআইয়ের (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) নিট প্রবাহ ছিল ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এ হিসেবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে ২৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উইকলি সিলেকটেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস জুলাই থেকে মার্চে মূলধনি যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি বা আমদানি বাবদ অর্থ পরিশোধ হয়েছে ১৫২ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল ২১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমেছে ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এটা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমার ইঙ্গিত দেয়।

এ নিয়ে কথা বলতে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত তার প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি ডয়চে ভেলে।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শনে গিয়ে ১৪ মে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না হয়, জোরাজুরি নয়, রাজি করিয়েই করতে হবে। কারণ, এটা এমন এক বিষয়, পুরো জিনিস শুনলে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

প্রধান উপদেষ্টার এই কথার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দল বিদেশিদের বন্দর দেওয়ার বিরোধিতা করছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে তারা কর্মসূচিও পালন করেছে। আরো বড় কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার। তারা অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য এসেছে। ফলে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যাতে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত সেই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাদের রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। তারা যে প্রস্তাব বা সিদ্ধন্তের কথা বলছেন সেগুলো কেন বলছেন, কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন, তার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ কী এই বিষয়গুলো তো আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে হবে। এককভাবে তারা তো এগুলো করতে পারেন না।

জোনায়েদ সাকি মনে করেন, এই সরকারের ম্যান্ডেট সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। এটার জন্য একটা জাতীয় ঐক্য আছে।

তিনি বলেন, সরকারের এমন কোনো কাজ করা ঠিক হবে না, তারা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যাতে এই ঐক্যে ফাঁটল ধরে বা বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়।

তবে বাম দলগুলোর এই বিরোধিতার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাংলাদেশের যমুনা টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, বামদের দ্বারা ইনফ্লিয়েনস্ড (প্রভাবিত) হলে বাংলাদেশে জব হবে না। বাংলাদেশকে উনারা ডুয়ার্ফ (বামন) বানিয়ে রাখতে চান, বনসাঁই বানিয়ে রাখতে চান।

তিনি বলেন, এই সরকারের মূল ম্যান্ডেট হলো সংস্কার। প্রত্যেকটা বিষয় সংস্কারের মধ্যে পড়ে। আমরা বন্দরের বিষয়ে যে কাজ করছি এটা বড় রকমের অর্থনৈতিক সংস্কার। এর ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে।

তিনি বলেন, আমরা যে মানবিক চ্যানেলের (রাখাইনে মানবিক করিডোর) কথা বলছি সেটাও একটা বড় সংস্কারের অংশ। কারণ আপনি দেখেছেন সাত বছর ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো ধরনের কোনো অগ্রগতি নাই। আমরা এক মিলিয়নের মতো রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে রেখেছি। এটা তো একটি বড় মানবিক ইস্যু। এটার একটা সমাধান খুঁজে বের করা তো বড় রকমের সংস্কার। আমরা তো এটা এড়িয়ে যেতে পারি না।

ঊষার আলো-এসএ