UsharAlo logo
সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আগুনের উচ্চঝুঁকিতে মদের অর্ধশত বার

usharalodesk
মার্চ ১১, ২০২৪ ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : উচ্চ ঝুঁকি সত্ত্বেও রাজধানীতে মদের অর্ধশত বারে অগ্নিনিরাপত্তার ছিটেফোঁটাও নেই। সাধারণ রেস্টুরেন্টের মতোই বারগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে রান্নাঘরে। আপৎকালীন জরুরি নির্গমন পথ নেই বেশিরভাগ বারে। এমনকি বারগুলোতে অ্যালকোহল মজুতের গুদামেও অগ্নিনিরাপত্তা অপর্যাপ্ত।

খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (নারকোটিক্স) সরেজমিন পরিদর্শনে বারগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তার এমন বেহাল চিত্র উঠে আসে। সম্প্রতি বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর রাজধানীর বারগুলো সরেজমিন পরিদর্শন শুরু করে নারকোটিক্স। অবশ্য ইতোমধ্যে এগুলোকে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রাত সাড়ে ১০টার পর রাজধানীর সব বার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নারকোটিক্স।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বার লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ফায়ার সেফটিসহ আরও বেশ কয়েকটি লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। বারগুলো যাতে নির্ধারিত সময় কঠোরভাবে মেনে চলে নারকোটিক্সের পক্ষ থেকে সেই তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, নারকোটিক্সের সরেজমিন পরিদর্শনে রাজধানীর নামিদামি কয়েকটি মদের বারে অগ্নি নিরাপত্তার করুণ চিত্র বেরিয়ে আসে। এমনকি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অ্যালকোহল মজুতের গুদামেও পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা নেই। অথচ সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মদের বারে অতিরিক্ত অগ্নি সতর্কতা নেওয়ার কথা।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অতি দাহ্য অ্যালকোহল মজুতের কারণে এমনিতেই মদের বারে অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকি থাকে। উপরন্তু বারে ব্যাপকভাবে ধূমপান করা হয়। ফলে সাধারণ রেস্টুরেন্টের তুলনায় মদের বারে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। আবার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অজুহাতে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটক বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখা হয়, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত বারে আগুন লাগলে প্রাণহানি বেশি হয়। বিশ্বের যেসব দেশে বার বা নাইট ক্লাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে সেখানে বহু প্রাণহানির নজির ভুরি ভুরি। উপরন্তু ঢাকায় বেশিরভাগ মদের বার বহুতল ভবনে। ফলে এ ধরনের ভবনের বারে আগুন লাগলে উদ্ধার তৎপরতায় বেগ পেতে হবে।

নারকোটিক্স বলছে, রাজধানীতে রেস্টুরেন্ট, ক্লাব ও আবাসিক হোটেল মিলিয়ে প্রায় শতাধিক মদের বার রয়েছে। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট ও ক্লাব বারের সংখ্যা সর্বোচ্চ। শর্তানুযায়ী বার লাইসেন্স পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ফায়ার সেফটি সনদসহ আরও বেশ কয়েকটি লাইসেন্স থাকতে হয়। কিন্তু মাঠ পরিদর্শনে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। এমনকি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হালনাগাদ ফায়ার সেফটি সনদ থাকলেও সেখানে আগুন নেভানোর প্রাথমিক উপকরণও মেলেনি।

নারকোটিক্সের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীর অন্তত ৫০টি মদের বারে অগ্নিনিরাপত্তা অপর্যাপ্ত। এর মধ্যে রয়েছে পল্টন কালভার্ট রোডের ঢাকা রেস্টুরেন্ট এন্ড বার, মগবাজারের পিয়াসী রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার, মিরপুর রোডের হোটেল গ্যালাক্সি, বাংলামোটর এলাকার গোল্ডেন ড্রাগন, প্রগতি সরণির ডিম্পল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার, মহাখালীর হোটেল জাকারিয়া, ফার্মগেটের হোটেল সালামার, কাওরান বাজারের হোটেল লা ভিন্সি, বনানীর হোটেল সারিনা, প্লান বি, হোটেল সুইট ড্রিম, লাকী রেস্টুরেন্ট এন্ড বার, পল্টনের হোটেল ফারস, খিলক্ষেত এলাকার হোটেল রিজেন্সি, বিজয়নগরের হোটেল ৭১, উত্তরা এলাকার লেক ভিউ রেস্টুরেন্ট এন্ড বার ও মার্গারিটা রেস্টুরেন্ট।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বনানীর হোটেল সারিনা ও সুইড ড্রিম এবং খিলক্ষেতের রিজেন্সি হোটেলের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। হোটেল সারিনায় ১৭ এবং ১৯ তলায় পরিচালিত হচ্ছে বার। এছাড়া ৮ তলায় বার থাকায় সুইট ড্রিমে গ্রাহকদের ওঠানামার একমাত্র মাধ্যম লিফট। দুটি ভবনেই আপৎকালীন বহিগর্মন পথ বা জরুরি সিঁড়ি নেই। এর মধ্যে খিলক্ষেতের রিজেন্সি হোটেলের রুফটফ মদের বারসহ বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা রোববার উচ্ছেদ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

বারের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল সুইট ড্রিমের বার ইনচার্জ রিফাত মাহমুদ রোববার কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা রয়েছে। এছাড়া আরও বেশকিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন নতুন করে নেওয়া হচ্ছে। সারিনা হোটেলের বার ম্যানেজার কাওসার আহমেদ নাহিদ বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলে বার থেকে নেমে যাওয়ার জন্য জরুরি নির্গমন পথ আছে। এছাড়া বারে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী মজুত রয়েছে।

বৃহস্পতিবার বনানী ১১ নম্বর রোডের বি টাওয়ারে অবস্থিত প্লান-বি নামের মদের বারে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ১১ তলায় পরিচালিত হচ্ছে বার। অথচ ভবনের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে সেখানে গ্লাস ফিটিংয়ের কাজ চলমান। লিফট স্থাপনের বিশাল ফোঁকর বাইরে থেকেই চোখে পড়ে। রেলিং না থাকায় সিঁড়ির একপাশ চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা। এছাড়া ভবনে জরুরি নির্গমন পথ নেই।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি ১১ তলায় বার চালু হয়। সপ্তাহে ৬ দিনই মধ্যরাত পর্যন্ত বার খোলা থাকে। গ্রাহকদের সবাই উঠানামা করেন লিফটে। তবে মদ পানের কারণে অনেক সময় গ্রাহকদের কেউ কেউ একা নিচে নামতে পারেন না। এমনকি লিফটে উঠতেও তাদের অন্যের সাহায্য নিতে হয়। ফলে আগুন ও ভূমিকম্পের মতো পরিস্থিতিতে বারে আটকেপড়াদের উদ্ধার করা কঠিন।

প্রতিষ্ঠানের অগ্নিনিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্ল্যান বি’র অন্যতম স্বত্বাধিকারী সাদ জামান রোববার কাছে দাবি করেন, ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কাছে পর্যাপ্ত আগুন নেভানোর সামগ্রী রয়েছে। তাছাড়া ভবনের নির্মাণকাজও প্রায় শেষ। উপরের দিকে এখন শুধু একটু ফিনিশিংয়ের কাজ বাকি। জরুরি ব্যবহারের জন্য ভবনে একাধিক সিঁড়িও আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীতে মধ্য এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির গ্রাহকরাই মূলত বারে গিয়ে মদপান করেন। এছাড়া পাশ্চাত্য ধারার আদলে বারে পার্টি কালচার বাড়ছে। এখন অনেকেই বন্ধু বা সহকর্মীদের নিয়ে পানীয় সহযোগে দীর্ঘ সময় আড্ডা দেন। এছাড়া রাজধানীর বহুজাতিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের একটি অংশ নিয়মিত বারে যাতায়াত করেন।

নারকোটিক্সের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় মদ পান বাংলাদেশে এখনো নেতিবাচক কাজ হিসাবে বিবেচিত। এ কারণে বেশিরভাগ গ্রাহক গোপনে মদ পান করেন। ফলে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সেভাবে তাদের মাথায় আসে না। অথচ বারেই আগুনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

তবে বার মালিকরা বলছেন, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের অজুহাতে সম্প্রতি বারগুলোতে অহেতুক অভিযান চালাচ্ছে নারকোটিক্স। অথচ এতদিন তাদের লোকজন প্রতি মাসের নির্ধারিত তারিখে বার পরিদর্শন করে আসছে। এখন হঠাৎ করে পুলিশ সহযোগে তারা বারে ঢুকে ব্যবসা বন্ধ করতে বলছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি তৈরি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট এবং বার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেজর (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসেইন বলেন, বার একটি স্পর্শকাতার প্রতিষ্ঠান। এটি অন্য আর দশটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। তদুপরি বারগুলো দেখভালের জন্য নারকোটিক্সের একজন সার্কেল পরিদর্শক নিয়োজিত আছেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তিনি নিয়মিত পরিদর্শন করেন। ফলে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের জের ধরে মদের বারে অহেতুক দমন-পীড়ন চালানো বাস্তবসম্মত নয়। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে যেভাবে বার ব্যবসা চলে এখানেও সেভাবেই চলতে দেওয়া উচিত।

ঊষার আলো-এসএ