ঊষার আলো প্রতিবেদক : সাথী দাস ঠিক এখন হতে প্রায় ৯ বছর আগে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নববধূ সেজে আসে দেয়ানা উত্তরপাড়া (ঋষিপাড়া) মোড়স্থ আশোক কুমার দাসের ছোট ছেলে সদানন্দ দাস সুজনের ঘরে। স্বামীর ভালবাসার হাতটি ধরে অনেক কষ্টে তিল তিল করে গড়ে তোলে একটি সাজানো গোছানো সংসার। দিন দিন সুজনসাথীর মধ্যে ভালবাসা বাড়তেই থাকে। একজন একটু আগে খেয়ে নিলে যেন সংসারে আর অশান্তি ধরে না। ভালবাসার এমন সুমধুর সর্ম্পক দেখে পাড়ার অন্যান্য বৌদিরা মিচি মিচি হাসে। সুজনসাথী জুটির বিয়ের ২ বছর পর পৃথিবীকে নতুন আলোয় আলোকিত করে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। বড় আদর করে নাম দেওয়া হলো মাণষী। দিন, মাস, বছর গড়িয়ে সন্তান যেন দেখতে দেখতে কলা গাছের মতো লম্বা হয়ে গেল। বয়স হলো ৭ বছর। হঠাৎ সুজন আর সাথী চমকে ওঠে। মেয়ে যে বড় হয়ে গেল রে। তাই দুজনকে আয় বাড়াতে হবে। সুজন তার প্রতিষ্ঠান হেয়ার ফ্যাশানে সময় বাড়িয়ে দিল, খাওয়া নেই, দাওয়া নেই শুধু কাজ আর কাজ। তবে সাথী ও বসা থাকার পাত্রী নয়। একমাত্র মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার জন্য নিজে সেই সকাল ৯ টায় বাড়ী হতে নিউ মার্কেটের একটি বিউটি ফার্লারে বিউটিশিয়ান হিসাবে কাজ করে আর বাড়ী ফেরে আসে রাত ৯ টায়। তবে হ্যা কর্মে যাওয়ার আগে স্বামী আর মেয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে সে কখনো ভূল করে না।
যখন কর্ম হতে বাড়ী ফেরে মেয়ে মানষী বলে- মামুনী ও মামুনী বলে লাফ দিয়ে কোলে উঠে পড়ে। সারাদিন পর মেয়ে কাছে পেয়ে সাথীও যেন বেশ স্বস্তি বোধ করে। তবে দুপুর বেলায় অবশ্য হাতে যতই কাজ থাকুক না কেন বাবা সুজন মেয়ের গোসল আর না খাইয়ে রেখে যায় না। আর সন্ধ্যায় তো নাস্তা বাধ্যতামূলক। মেয়ের যে কত প্রকার পোশাক, জুতা আর সাজার জিনিস তা গুনে যেন শেষ করা যাবে না। প্রতি পুজাতে মেয়ে দিতে হয় কয়েক সেট জামা আর সারা মাস তো পড়েই থাকলো। বাড়ীতে কেবল মা-বাবা নয় বরং জ্যাঠা, জেঠি, ঠাকুর দাদু, ঠাকুর মা, বড় মা’র প্রান যেন মানুষী। সকলেই আদর করে মানু সোনা বলে তাকে ডাকে। বিকাল হলেই বোনের সাথে (জ্যাঠার মেয়ে) পাড়ায খেলতে নামে। এমন কেউ যে তার সাথে মানষীর ভাব নেই। মানষী আজ কোথায়?
৫ মার্চ সন্ধ্যায় বাবা, মা আর মানষী মোটর সাইকেল যোগে খুলনার দৌলতপুরের ঋষিপাড়া হতে আত্বীয়া কেশবপুরের ভেরচী গ্রামের অমরেশ দাসের মেয়ের বিয়ের উদ্দেশ্য দেয় পথিমধ্যে রওনা হওয়ার সময় সাকিব সাথী নামের সাতক্ষীরা মন্টু মিয়ার বাগান বাড়ী পিকনিক স্পট হতে ছেড়ে আসা বাসটি স্ব-পরিবারকে ধাক্কা দিলে মানষী রাস্তা উপর ছিটকে পড়ে গেলে ঘাতক বাসটির পছনের ডানপাশের চাকা মাথার উপর দিয়ে উঠিলে দিলে ঘটনাস্থলে মারা যায় শিশু মানষী। একই রাত সাড়ে ৩ টার দিকে লাশটি নিজ বাড়ীতে পৌচ্ছালে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সমগ্র এলাকজুড়ে। চারিদিকের কাঁন্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
আজ তিনদিন গত হয়ে গেল মানষী নেই। মানষী তার চিরচেনা স্থান দেয়ানা ঋষিপাড়ার নিজ বাড়ী ছেড়ে অজানা-অচেনা কোন এক নতুন শহরের উদ্দেশ্য পাড়ি দিয়েছে। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে মা আজ বাকরুদ্র পাগল প্রায়। তিন দিন অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সে। শুধু মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে বলছে ও মানু, মানুরে, তুই কইরে সোনা, আমার বুকে আয়। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। মানু সাজবিনা, ও মানু মাথায় খোপা করবি না, মানু রে মাথায় শ্যাম্পু করবি না? আবার অচেতন। বাবা সুজন ও বাকরুদ্র , বলছে আবোল তাবোল কথা। এই যে আমার মানু। কে কইছে আমার মানু নেই। প্রতিদিনই আমার মানু’র জন্য খাবার নিয়ে আসি আমি। আজ ও আনবো। দোকান কি খোলা। আবার চুপ? মানষী দাস সবুজ সাথী প্রি-ক্যাডেট বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেনীর ছাত্রী। বিদ্যালয় সূত্র জানা যায়, মানষী ছিল অত্যন্ত নরম, মিশুক আর সাদামাঠা একটি শিশু। যে কখনো কারো সাথে কখনো কালো মুখ করে কথা বলেনি, শুধু পাকা পাকা কথা বলতো। সে অত্যন্ত মেধাবী। বিদ্যালয়ের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার প্রদর্শন ছিল চোখে পড়ার মতো। আজ কেবল পড়ে আছে মানষীর সৃত্মি আর কথা। নেই কেবল শিশু মানষী। তাকে হারিয়ে মা সাথী আজ বাকরুদ্র, পাগল প্রায়। সকলের দাবি, সময়ের দাবি যে নিঃস্পাপ শিশু আগামী দিনের বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে, গড়বে দেশ, হবে কোন স্বনামধন্য ডাক্তার বা ইজ্ঞিনিয়ার। সে কোথায় আজ?
সড়কে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো ঘাতক বাস কেড়ে নিলো এ জাতির আগামী দিনের দেশ গড়ার একটি ফুটন্ত গোলামকে। মানষী হারা পরিবারটি কোনদিন আর তাকে ফিরে পাবে না তবে যেন ঘটনার সুস্থ বিচার পায়। মানষী শিশু তাই সনাতন ধর্মের সকল রীতি রেওয়াজ মেনে গত ৬ মার্চ দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে খুলনার রুপসা মহাশ্মশানে মানষীর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।