ঊষার আলো রিপোর্ট : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ২৬টি ক্যাডারে আন্তঃবৈষম্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ক্যাডারগুলোর মধ্যে পদোন্নতি, গ্রেড-১ পদ, বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি লোন, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা ক্ষেত্রে এ বৈষম্য বিরাজমান।
আগের সরকারগুলো প্রশাসনের এ বৈষম্য নিরসনের পরিবর্তে দু’একটি ক্যাডারকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় এ অবস্থা প্রকট হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বৈষম্য নিরসনের দায় চেপেছে বর্তমান সরকারের কাঁধে। জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন এ নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে। এতেই তৈরি হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাজ না।
বরং কমিশনের কাজ হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে জনসেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় তার সুপারিশ করা। ঘুস, দুর্নীতি বন্ধ করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কমিশনকে যুগোপযোগী সুপারিশ করতে হবে।
চাকরিতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান। এটা দফায় দফায় বেড়েছে। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ আছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। এ সময় প্রশ্ন উত্তরে বেরিয়ে আসে কমিশন পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা নিয়ে কাজ করছে।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিরাজমান বৈষম্য নিরসনে তারা সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন। বিষয়টি নতুন করে সামনে আসায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে, যা ক্যাডারগুলোর মধ্যে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে দাবি আদায়ের জন্য প্রশাসন ছাড়া ২৫টি ক্যাডার আগামী চার জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। মহাসমাবেশ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিসট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সভাপতি ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বিভিন্ন ক্যাডারে জনবল নিয়োগ দেয়। প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডারে যদি কেউ চাকরি করতে না চায় তাহলে সে একাধিকবার পরীক্ষার অংশ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে পারেন।
কিন্তু একটি ক্যাডারে ঢুকে অন্য ক্যাডারের পদ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা অনুচিত। প্রশাসন মেধাবীদের ক্যাডার এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনের মাধ্যমে এ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা আরও শানিত হয়। তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডারগুলোতে যদি সরকার সুযোগ-সুবিধা কম দেয়, তাহলে তারা সেসব বিষয় যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। আমরা তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি নৈতিক সমর্থন দেবে।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান বলেন, দাবি করা হয়, প্রশাসন মেধাবীদের ক্যাডার। আমরাও তাই মনে করি। তাহলে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি নিতে তাদের তো আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে তারা পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি না নিয়ে তারা অটো-পদোন্নতি চায়।
দেওয়ান ফারুক আরও বলেন, উপসচিব ঊর্ধ্ব পদগুলো কোনো ক্যাডারের পদ না বরং সরকারের পদ। ওই পদে একটি ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে পদোন্নতি দিয়ে দিতে হবে, এটা এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব এবং একপেশি সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, সব ক্যাডারের সমতা থাকতে হবে। সব ক্যাডারের পদোন্নতি একদিনে এবং এক তারিখে হবে। একটি ক্যাডার পাঁচ বছর পূর্ণ হলে অটো পদোন্নতি পাবে, পক্ষান্তরে অন্য ক্যাডারগুলো ১৫ বছর পর একটি পদোন্নতি পাবে তা কী করে হয়।
তিনি বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য চতুর্থ গ্রেড নেই। তারা তৃতীয় গ্রেড থেকে সরাসরি দ্বিতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পায়। পক্ষান্তরে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য চতুর্থ গ্রেড সৃষ্টি করে তাদের ল্যাং মারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং আমরা সব ক্যাডারের মধ্যে সাম্য ও সমতা চাই। যেহেতু সব ক্যাডার একই বিসিএস নিয়োগ পেয়েছি, সুতরাং আমরা একই সঙ্গে পদোন্নতি পাওয়ার দাবি করছি। যদি বলা হয় পদ নাই। আমরা বলব পদ তো প্রশাসন ক্যাডারেরও নেই। কিন্তু তাদের পদোন্নতি হবে অন্যরা বাদ পড়বে এমন অসমনীতি মানি না। সুযোগ-সুবিধার জায়গায় তো পাহাড়সম বৈষম্য রয়েছেই।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাজ না। সংস্কার কমিশনের কাজ হচ্ছে জনগণের সেবার উন্নয়ন কীভাবে ঘটবে প্রশাসনকে সেভাবে সাজাতে হবে। কীভাবে জনস্বার্থ সমুন্নত রাখা যায়, তা নিয়ে সুপারিশ করা। প্রশাসনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা। জনগণ কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা পাবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী সুপারিশ করাই এই কমিশনের কাজ।
তিনি বলেন, জনসেবা বলতে এখন আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কর্মচারীরা এখন মানুষের সঙ্গে প্রভুর মতো ব্যবহার করেন। সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে মনে করেন। তাদের কাজ হচ্ছে গণমানুষের চাহিত সেবা দেওয়া। কিন্তু তারা সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ঘুস নিচ্ছে। সুবিধা দেওয়া ছাড়া মানুষ সেবা পায় না। অনেক সময় টাকা-পয়সা খরচ করেও মানুষ ন্যায্য সেবা পায় না। এসব অনিয়ম দূর করে জনমুখী জনপ্রশাসন তৈরির বিষয়ে কাজ করার কথা কমিশনের। সুতরাং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা এই কমিশনের কাজ না।
তিনি আরও বলেন, আন্তঃক্যাডারের যেসব সমস্যা আছে সেগুলো সমাধানে অনেক লেখাপড়া করা দরকার। সমস্যা থাকলে কমিটি করে দীর্ঘ গবেষণা শেষে তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা দরকার। হুট-হাট কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা বাস্তবায়িত তো হবেই না বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। ফিরোজ মিয়া উদাহরণ দিয়ে বলেন, এখন যে বিভিন্ন ক্যাডার রি-অ্যাক্ট করল এটা থামানোর মতো রাজনৈতিক সমর্থন কি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আছে?
বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রফেসর মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন ক্যাডার ৭ ধাপে পদোন্নতি পায়, আমরা পাই ৪ ধাপে। লেকচারার, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক। এ কারণে আমাদের মধ্যে বেতন-ভাতার বৈষম্য রয়েছে। দ্বিতীয় হচ্ছে তারা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুযোগ পায় এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে পায়, আমরা তা পাই না।
প্রশাসন ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ অনেক পক্ষান্তরে শিক্ষা ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ একটি। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের বরাবর এগিয়ে পক্ষান্তরে অন্য ক্যাডারের বিদেশ ভ্রমণেও তারা ভাগ বাসায়। এসব কারণে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিয়ে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। ক্যাডারগুলোর মধ্যে বৈষম্য পাহাড়সম। তিনি আরও বলেন, আমরা এসবের অবসান চাই।
প্রশাসন ছাড়া ২৫টি ক্যাডারের মহাসমাবেশের ডাক : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান পদোন্নতির ক্ষেত্রে উপ-সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া এবং প্রশাসন ক্যাডার ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার ৫০ শতাংশ আনুপাতিক হার নির্ধারণে যে সুপারিশ করবেন বলে মত দিয়েছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। সংগঠনটি মহাসমাবেশ ও কলম বিরতিসহ বেশ কয়েক দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।
এর মধ্যে আগামীকাল (২৩ ডিসেম্বর) প্রতিটি ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উদ্ভূত পরিস্থিতি বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করবে। ২৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা সব অফিসে কলমবিরতি পালন করবে। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সব অফিসে স্ব-স্ব কর্মস্থলের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে। যেসব বিভাগে বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়নি, অতি দ্রুত সেখানে সমাবেশ আয়োজন এবং জনসম্পৃক্ততা আরও বৃদ্ধি করা হবে। আগামী ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ আয়োজন করা হবে এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
শনিবার গণপূর্ত ভবনের অডিটরিয়ামে সংগঠনের এক সভা শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায় সংগঠনটি।
ঊষার আলো-এসএ