ঊষার আলো ডেস্ক : রাজধানীর আরমানিটোলায় হাজী মুসা ম্যানশন ভবনের নিচে অপেক্ষায় আছেন ভবনের বাসিন্দারা। গতকাল ভবনটি সিলগালা করে দেয়ায় এক কাপড়ে বের হয়ে যান তারা। যে যার মতো স্বজনের বাসায় রাত কাটিয়েছেন। ভবনে উঠতে পারবেন কিনা, বা কবে জিনিসপত্র বের করতে পারবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তার ছাপ সবার মুখে।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) সকাল থেকে ভবনের নিচে অপেক্ষা করছিলেন তিনতলার ভাড়াটিয়া রাশিদা আক্তার। আগুন লাগার পর গ্রিল কেটে নিচে নেমে আসেন। পরে আর ভবনে ঢোকার সুযোগ হয়নি। শনিবার সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলেন ঢোকা যাবে কিনা।
রাশিদা জানান, আগুন লাগার কথা মনে হলেই বুক কেঁপে ওঠে। রাত কাটিয়েছি আত্মীয়ের বাসায়। ভোরে যখন সেহরি খাবো, তখনই তিনটার পরে সিঁড়িতে আগুন। সবার চিৎকারে ভয়ানক এক পরিবেশ তৈরি হয়। আর্তনাদ ছিল সবার মুখে। আমি ও আমার দুই ছেলে বারান্দার গ্রিল কেটে ওড়না আর চাদর দিয়ে দড়ি বানিয়ে নেমে আসে। তখন কিভাবে এত সাহস পেয়েছি বুঝতে পারিনি।’
রাশিদা আক্তারের মতো অনেক ভাড়াটিয়া গতরাত থেকে এখনও ঠিকমতো বিশ্রাম নিতে পারেননি। হাতমুখ পর্যন্ত ধোয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। নিচে অপেক্ষারত তৃতীয় তলার আরেক বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী আকাশ বলেন, এই ভবনে আর থাকব না। মালামাল পেলেই চলে যাবো।
কাউন্সিলর যা জানালেন
ঢাকা জেলা প্রশাসন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে পুড়ে যাওয়া ভবনটিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় সিলগালা করে দেয়া হয়। ডিএসসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলমগীর দেখভাল করছেন ঘটনা পরবর্তী বিষয়। ভাড়াটিয়ারা মালামাল নিয়ে যেতে পারবেন কবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুয়েক দিনের মধ্যেই জানিয়ে দেবো মালামাল সরিয়ে নিতে। সবচেয়ে বড় বিষয়, আগুন লাগার ফলে ভবনটির স্ট্রাকচারাল কোনও ক্ষতি হয়েছে কিনা সেটা জানতে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। বসবাসের উপযোগী হলে ভাড়াটিয়ারা পরে এখানে থাকতে পারবে। কেউ চলে যেতে চাইলে আমরা সহায়তা করব। তবে এখনই মালামাল নিতে পারবেন না। এক-দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরাও চাই ভাড়াটিয়ারা যেন আর কষ্টের মধ্যে না পড়েন।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের বক্তব্য
এ ঘটনায় নিহতদের দাফনের ব্যবস্থা করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। সিলগালার মূল কাজটি করছে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা । ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি বলেন, ‘ভবনের ভাড়াটিয়াদের কবে নাগাদ ভবনে উঠতে দেয়া হবে, সেজন্য সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ভবনটি একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থার পর তারা ব্যবস্থা নেবেন।’
সুনসান নিরবতা
ভবনের অনেক অংশেই আগুনের তীব্রতার ক্ষত। ভাঙা গ্লাস ও কাটা গ্রিল বহন করে আছে ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি। কোলাহলপূর্ণ ভবনটিতে এখন সুনসান নীরবতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে সামনে। প্রতিটি কোনায় আছে পুলিশের নজরদারী।
এ ব্যাপারে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিন ফকির বলেন, ‘ভবনটি সিলগালা হবার পর থেকে আমরা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। কেউ যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রতিটি গেট ছাড়াও আশপাশে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’
কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক
শনিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরের দিকে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন শিল্প মন্ত্রণালয় একটি প্রতিনিধি দল। এর পাশেই থাকা বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে বৈঠক করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল।
বৈঠক শেষে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি আল পার্ক মুন্সীগঞ্জের প্রকল্প পরিচালক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন আগুনের ঘটনায় তিনজন সিকিউরিটি গার্ড মারা গেছেন। আসলে তারা প্রস্তুত ছিলেন না। আগুন লাগার পর ধোঁয়ার কারণেই মারা গেছেন।
কেমিক্যাল মজুদ রাখা না রাখা কিংবা বৈধতার বিষয়টির দায়িত্ব আমাদের নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করছি। ২০২২ সালের আগে সেখানে ব্যবসা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যাদের বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স আছে, তাদের নিজস্ব গুদাম আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না রেখে নিজস্ব লাইসেন্সকৃত গুদামে রাসায়নিক মজুদ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
নজরদারীর বিষয়ে মন্ত্রণালয় বিষয়টি এড়িয়ে তিনি বলেন যারা ট্রেড লাইসেন্স দেয় তাদেরই সচেতন হতে হবে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ থাকলেও প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কিন্তু এমন ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। শ্যামপুরে ও নরসিংদীতে গোডাউন তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে রাসায়নিক রাখা গেলে এ ধরনের ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব হবে।
বৈঠকের বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন বলেন, এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ব্যবসায়ীদের জায়গা বরাদ্দের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন ২০২২ সালের আগে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কাজ শেষ হবে না।
এর আগে কোথায় রাখা হবে এসব রাসায়নিক দ্রব্যাদি, এমন বিষয়ে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আরিফ হোসেন বলেন, তারা জায়গা দেবে, এ ব্যাপারে তারা কোনও গাইডলাইন দিচ্ছে না।
অতি দাহ্যবস্তু যেগুলো আছে সেগুলো সরিয়ে কোথায় রাখা হবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কিছু বলেছেন কিনা জানতে চাইলে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, যাদের নির্দিষ্ট গোডাউন রয়েছে সেখানে রাখতে হবে। তবে সবার তা নেই।
ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখনও ভুলতে পারছেন না এলাকাবাসী।
কার্যকর ব্যবস্থা চায় স্থানীয়রা
বারবার পুরান ঢাকা আগুনের ঘটনা ঘটে। কোনও একটি ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় তৎপরতা। কিছুদিন পর সব আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অজানা কারণে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
৩১ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফার লেন পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন বুলবুল বলেন, আমরা চাই পুরান ঢাকায় যে আর আগুন না লাগে। কিন্তু কেমিক্যাল মজুদ থাকলে প্রাণহানি ঘটবেই। মজুদ করা কেমিক্যাল থেকে আগুন ছড়িয়ে যায় আশপাশের এলাকা থেকে পুরো ভবনে। অবৈধ রাসায়নিক মজুদ কিংবা ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে এমনটাই আশা করি।
বেচারাম দেউরী পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ‘কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর জন্যই প্রতিবছর পুরান ঢাকায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ভবন মালিকদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে কথা বলে তাদের সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছি। তারা যেন বেশি ভাড়ার লোভে নিচতলায় রাসায়নিকের গোডাউন বানিয়ে মরণফাঁদ তৈরি না করে।’
(ঊষার আলো-এমএনএস)