কাশ্মিরে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে পাকিস্তানের। ২২ এপ্রিলে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের পর্যটননগরী পাহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। এর পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে পালটা পালটি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা একটি বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়ার জবাবে শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান। শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে সোমবার (২৮ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে আল জাজিরা।
এতে বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর নয়াদিল্লি একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার মধ্যে রয়েছে—৬০ বছরের পুরোনো সিন্ধু পানি চুক্তি এর স্থগিতাদেশ, পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ, সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা এবং পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানো।
এর জবাবে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি—যেটি দেশটির শীর্ষ নাগরিক ও সামরিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থা—একই ধরনের পদক্ষেপ ঘোষণা করে। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য ও আকাশসীমা স্থগিত, সীমান্ত বন্ধ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি।
শিমলা চুক্তি কী?
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সাত মাস পর, ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো হিমাচল প্রদেশের শিমলায় এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর লক্ষ্য ছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা ও বিরোধ নিষ্পত্তির পথ খোঁজা।
চুক্তির মূল বিষয়ের মধ্যে ছিল—সীমান্ত-সংক্রান্ত বিরোধ ও কাশ্মির ইস্যু শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিক উপায়ে সমাধান করার অঙ্গীকার। এটি দু’দেশকে একতরফাভাবে সীমান্ত পরিস্থিতি পরিবর্তন না করার এবং পারস্পরিক সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধবন্দি ৯০,০০০ পাকিস্তানি সেনার মুক্তির পথও খুলে দেয় চুক্তিটি।
পাকিস্তানের হুমকির তাৎপর্য কী?
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সূফি বলেন, শিমলা চুক্তি একান্তই একটি অস্থায়ী তবে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো, যা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছিল। চুক্তি স্থগিত করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণভাবে অনেক গভীর মূল্যায়ন করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
আরেক আইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মুশতাক আহমদ জানান, ভারত দীর্ঘদিন ধরেই শিমলা চুক্তিকে জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহের ওপরে স্থান দিয়েছে। ভারতের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মির ইস্যু একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় হয়ে গেছে, যেখানে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার আর কোনো প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে পাকিস্তান মনে করে, শিমলা চুক্তি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তগুলোকেই আবারও দৃঢ় করে এবং কূটনৈতিকভাবে কাশ্মির সংকট সমাধানের ওপর জোর দেয়।
বিশেষ করে ২০১৯ সালে ভারতের মোদি সরকার কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করলে পাকিস্তান তা শিমলা চুক্তির লঙ্ঘন বলে দাবি করে। আন্তর্জাতিক চুক্তির আইন অনুযায়ী, কোনো পক্ষ যদি চুক্তি লঙ্ঘন করে, তাহলে অপর পক্ষ তার অংশগ্রহণ বাতিল করার অধিকার রাখে। পাকিস্তান সই করলেও ভারত ভিয়েনা কনভেনশনের অংশ নয়।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা মনে করেন, যদি দুই দেশই শিমলা চুক্তি থেকে সরে যায়, তাহলে কার্যত নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে ‘ওপেন সিজন’ শুরু হবে। তখন অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়বে, কারণ আর কোনো শান্তিপূর্ণ চুক্তির বাধ্যবাধকতা তখন আর কার্যকর থাকবে না।
চুক্তি বাতিল মানেই কি যুদ্ধ?
চুক্তি থাকার পরেও ভারত-পাকিস্তান একাধিকবার সংঘাতে জড়িয়েছে। সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে ৪০ বছরের দখলদারি থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ তার উদাহরণ।
পাকিস্তানি সংবিধান বিশেষজ্ঞ রিদা হোসেন মনে করেন, ভারত বরাবরই শিমলা চুক্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল চেতনা ভেঙে দিয়ে এখন ভারত ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাষায় কথা বলছে।
তবে অজয় শুক্লা বলেন, পাকিস্তানের শিমলা চুক্তি থেকে সরে যাওয়া সরাসরি যুদ্ধ ডেকে আনবে না, তবে এটি সংঘাতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
তিনি বলেন, চুক্তি ভেঙে গেলে দুই পক্ষের জন্যই আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
তাহলে পাকিস্তানের কৌশল কী?
শিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি দিলেও পাকিস্তান এখনও তা কার্যকর করেনি। বিশ্লেষক সূফি বলেন, ইসলামাবাদের উদ্দেশ্য সম্ভবত বহুপাক্ষিকতার পথে ফিরে যাওয়া। শিমলা চুক্তিকে বাতিল করলে জাতিসংঘের মাধ্যমে কাশ্মির ইস্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হবে।
অজয় শুক্লা বলেন, চুক্তি স্থগিতের মাধ্যমে উভয় পক্ষ নিজেদের স্বার্থে সীমান্তে আরো বেশি সক্রিয় হতে পারবে, যা চুক্তি কার্যকর থাকা অবস্থায় সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞ আহমদ মনে করেন, ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করাই এক ধরনের ‘আগ্রাসী পদক্ষেপ’, যার বিপরীতে পাকিস্তান আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী, ইন্দুস, ঝিলম ও চেনাব নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ। এই নদীগুলোর পানি প্রায় ২৫ কোটি পাকিস্তানির জীবননির্ভরতা নিশ্চিত করে।
তাই পাকিস্তান সরকারের শিমলা চুক্তি স্থগিতের হুমকিকে তিনি দেখছেন একটি কৌশলগত স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যা ভারতের প্রতি একটি কঠোর বার্তা পাঠায়।
ঊষার আলো-এসএ