গুমের শিকার ব্যক্তিদের গাড়ির সামনে ফেলে হত্যার চেষ্টা, গর্ভবতী নারীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং নবজাতককে মায়ের দুধ পান করতে দেওয়া হয়নি। লোমহর্ষক নির্যাতনের এমন আরও তথ্য উঠে এসেছে গুম কমিশনের প্রতিবেদনে। ১৫ বছরে গুম এবং হত্যা ও নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনা সিনেমার কাহিনিকেও হার মানায়। এসব ঘটনার সঙ্গে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যরা জড়িত। পূর্বসূরিদের বাঁচাতে ৫ আগস্টের পরও ডিজিএফআইর তৎকালীন মহাপরিচালক আগের অপরাধের আলামত মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। মঙ্গলবার গুম কমিশনের প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রথম অংশ প্রকাশিত হয় গত ১৫ ডিসেম্বর।
প্রসঙ্গত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গুমসংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী। গত ১২ ডিসেম্বর তারা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের পর ভয়ংকরভাবে নির্যাতন চালানোর পর হত্যা করা হয়। কখনো হত্যা করা হয়েছে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরপর অধিকাংশ লাশের সঙ্গে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলা হয়েছে। আবার কখনো রেললাইনে ফেলে রেখে লাশ বিচ্ছিন্ন করতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা হয়েছে। সুস্থ মানুষের ঠোঁট সেলাই করাসহ শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে দেওয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক শক।
ভুক্তভোগী ও পরিবারের ওপর প্রভাব : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনার শাসনকালে, গুমের শিকার পরিবারগুলো বিচার এবং মৌলিক অধিকার থেকে ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা বারবার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তদন্ত বা সত্য উদ্ঘাটনে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘উপরের নির্দেশ’ আছে, সামনে আগানো যাবে না। অনেক সময় গুমের অভিযোগ নিয়ে গেলে বলেছে, এগুলো ভিত্তিহীন। তারা ‘ঋণ’ থেকে বাঁচতে অথবা ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপন করেছে। অন্যদিকে যেসব ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন, তারা হয়রানির শিকার। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ কিংবা ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আদালত থেকে ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিকার পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে দায়ের করা ‘হেবিয়াস কর্পাস’ (কোনো ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে আটক থেকে আদালতে উপস্থিত করার নির্দেশ) পিটিশনগুলো দাখিলের পর অগ্রসর হয়নি। উলটো প্রকৃত বিচার না করে আদালতের কয়েকটি রায় অপরাধের বৈধতা দিয়েছে। যেসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুমের সঙ্গে জড়িত, নিু আদালত তাদের ওপরই অতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিলেন। ফলে ভুক্তভোগীরা প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। আদালতই অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়েছেন।
যারা জীবিত ফিরে এসেছিলেন, তাদের দুর্দশাও কাটেনি। তারা ক্রমাগত হুমকির মুখে থাকতেন। ফলে অভিজ্ঞতা শেয়ার কিংবা ন্যায়বিচার চাইতে পারেননি। ন্যায়বিচারের অভাব, বিচার বিভাগের নিরাপত্তার ঘাটতি এবং অপরাধীদের প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি ভুক্তভোগীদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবিতরা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অপরাধীর তকমা পেতেন। গুমের শিকার ব্যক্তিরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কলঙ্ক এবং বন্দিত্বের কারণে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পদ শেষ হয়েছে। ফলে তারা এখন আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত।
নারী ও শিশু ভুক্তভোগী : প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে-পুরুষের তুলনায় গুমের শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা কম। আবার অনেক নারী সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে চাননি। তবে অনেক সাহসী নারী তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। অপহরণ, বন্দিকালীন নির্যাতন এবং আইনি লড়াই পুরুষের সঙ্গে মিল আছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে টার্গেট হয়েছিলেন। নারীদের গুমের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো, অনেক ক্ষেত্রে নারীরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে গুম হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন নারী গর্ভাবস্থায় ছিলেন। এ সময়ে তার তিন বছর এবং দেড় বছর বয়সি দুই সন্তানকে গুম করা হয়। ওই নারীকেও সন্তানদের সঙ্গে এক মাস বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও একজন পুরুষ কর্মকর্তা তাকে মারধর করে। ছয় বছরের একটি শিশু জানায়, তাকে মায়ের সঙ্গে সিটিটিসিতে আটক রাখা হয়েছিল। অন্য এক ঘটনায়, মা এবং তার কন্যাকে তুলে নিয়ে রাতভর র্যাব ২ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে রাখা হয়। পরের দিন মেয়েটিকে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। এরপর এক ইমাম মেয়েটিকে পেয়ে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তার মা আর ফিরে আসেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে শুরু করে ঢাকার সিটিটিসি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এক পুরুষ ভুক্তভোগী জানান, তার স্ত্রী ও নবজাতক শিশুকে থানায় আনা হয়েছিল। যেখানে শিশুটিকে মায়ের দুধ পান করতে দেওয়া হয়নি।
বহুমুখী প্রভাব : গুমের ঘটনা ভুক্তভোগীদের পরিবারের ওপর বহুমুখী প্রভাবফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে-গুরুতর মানসিক আঘাত, আইনি এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জ। পরিবারের সদস্যরা গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি, হয়রানি ও ভয়ভীতিতে ছিলেন। গুম হওয়া একজনের কিশোরী কন্যা, স্কুলের পোশাক পরে কমিশনের অফিসে আসে। তার বাবা প্রায় এক দশক আগে ঘুম হয়েছে। বাবার কোনো স্মৃতি নেই। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ৫ আগস্ট পরিবর্তনের পরও আমরা ভয়ে আছি। নিখোঁজ পরিবারগুলো সামাজিকভাবে অপমানিত হন। আওয়ামী লীগও গুম হওয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়েছে। একজন ভুক্তভোগীর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তার ছেলেকে গুম করে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর ফলে প্রতিবেশীরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী প্রভাব : আলোচ্য সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেসামরিক এবং সামরিক উভয় বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপরাধের জন্য কখনো দায়বদ্ধ হবে, এটা তারা আশা করেননি। এগুলোকে তারা অপরাধ হিসাবেও দেখতেন না। নিয়মিতভাবে গুমের ঘটনাকে তুচ্ছ হিসাবে দেখানো হতো। একইভাবে হেফাজতে নির্যাতনে বিষয়গুলো নির্দ্বিধায় বর্ণনা করা হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের ১৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি। অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি অভিযোগে অন্তত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকায় এসব ঘটনাকে গুম হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে কমিশন। সেগুলো হলো-ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া। অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা ও মুক্তি এই পাঁচটি ভাগে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল উপায়ে গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়।
ঊষার আলো-এসএ