অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যাগে বিমানবন্দরে লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। তিনি কি আদৌ এ ধরনের লাইসেন্স পেতে পারেন-এমন প্রশ্ন সামনে আসায় এ বিষয়ে আইনে কী আছে তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
এ-সংক্রান্ত আইনে মন্ত্রী-এমপিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে কর প্রদানসহ অন্য বিধান শিথিলযোগ্য। এ জাতীয় ব্যক্তিদের বয়সের বিষয়ে তেমন কিছু বলা নেই। সমালোচনার মুখে অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে উপদেষ্টা নিজেও ফেসবুক পোস্টে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এদিকে, আগাম ঘোষণা ছাড়া কারও পক্ষে বিমানের কেবিন ব্যাগেজে অস্ত্র বা এ জাতীয় কিছু বহনের সুযোগ নেই এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ-এমন মন্তব্যই করেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এ বিধান বিশিষ্ট ব্যক্তি বা সাধারণ নাগরিক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এয়ারপোর্টে দুই দফা স্ক্যানিং করার পরও এটা ধরা পড়েনি-এক্ষেত্রে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সবার ক্ষেত্রে যেন আইনটা প্রয়োগ করা হয় এটা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এটা কিন্তু একে-ফোরটি সেভেন না। এটা তারই (উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ) একটি লাইসেন্স করা হাতিয়ার। পিস্তলের একটি ম্যাগাজিন যে থাকে, এটি একটি খালি ম্যাগাজিন যা ভুলে রয়ে গিয়েছিল। এটা আসলে ভুলেই হয়েছে। অনেক সময় এমন হয় যে, আপনি একটি চশমা নিয়ে যাবেন কিন্তু চশমা না নিয়ে মোবাইল নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন। এটা জাস্ট একটি ভুল। তিনি যদি আগে জানতে পারতেন তাহলে কোনো অবস্থাতেই এটা নিতেন না।
বৈধ লাইসেন্স পেতে বয়স ত্রিশ বছর হওয়া লাগে। কিন্তু উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বয়স ত্রিশ হয়নি। তাহলে তিনি এটা কীভাবে পেলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি যেহেতু ওই আইনটি দেখিনি। সেহেতু এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
আইনে আরও বলা আছে, আগাম ঘোষণা ছাড়া কারও ব্যাগে অস্ত্র ধরা পড়লে সিভিল? এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। তবে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র বহনের দরকার হলে তার জন্যও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। তখন লকড প্যাকেজে ও প্যাকিং নীতি মেনে আগে ঘোষণা দিয়ে চেক-ইন লাগেজে গুলি ও ম্যাগাজিন নেওয়া যায়। অপর দিকে বাংলাদেশের চেকিং পার হয়ে অন্য কোনো দেশে ধরা পড়লে সে দেশের আইন অনুযায়ীও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রোববার তার্কিশ এয়ারলাইন্সের টিকে-৭১৩ নম্বর ফ্লাইটে ঢাকা থেকে তুরস্ক হয়ে মরক্কোতে যাচ্ছিলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। সেখানে মারাক্কেশ ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল-২০২৫ অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন। সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অতিক্রমের সময় তার সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগে অ্যামোনেশন ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। স্ক্রিনিংয়ের সময় সেটি শনাক্তের পর দুঃখ প্রকাশ করে এবং ব্যাগ থেকে ম্যাগজিনটি বের করে তার প্রোটোকল অফিসারের কাছে জমা দেন। পরে সকাল ৭টায় তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ বলেন, সকালে বোর্ডিং করার আগে প্রি-বোর্ডিং স্ক্রিনিং করার সময় তার সঙ্গে থাকা পাউচের (ছোট ব্যাগ) মধ্যে ম্যাগাজিন পাওয়া গিয়েছিল। ম্যাগাজিনটি শনাক্তের পর সেটি ভুলবশত লাগেজে এসেছে জানিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি তার প্রোটোকল অফিসারের কাছে ম্যাগাজিনটি পাঠিয়ে দেন।
আগাম ঘোষণা ছাড়া অস্ত্র বা এ জাতীয় বস্ত্র বহনের বিষয়টি তুলে ধরে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, আগাম ঘোষণা ছাড়া কোনো ধরনের অস্ত্র বহন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ঘোষণা দিয়ে নিতে হলে সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অস্ত্র বহনের জন্য এনটাইটেল কিনা সেটি জানান দিতে হবে। একই সঙ্গে বিমানবন্দর অতিক্রমের আগে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে অস্ত্র বহনের কথা ঘোষণা করতে হবে। এই বিশেষ ব্যতিক্রমের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কাজে কেউ অন্য দেশে গেলে কিংবা আইনসংশ্লিষ্ট বাহিনী গেলে সেক্ষেত্রে কিছু নিয়ম রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির ব্যাগেজে অস্ত্র বহন করার সুযোগ নেই। এগুলো লাগেজে সিল্ড করে দেওয়া হয়, যেন দুর্ভাগ্যজনকভাবেও কেউ ব্যবহার করার সুযোগ না পায়।
এদিকে আসিফ মাহমুদের বিষয়ে ফেসবুকের সমালোচনামূলক পোস্টে দেখা গেছে, অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬ এর ধারা ৩(খ) উল্লেখ করে অনেকে সমালোচনা করছেন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগসহ তাদের সমর্থক গোষ্ঠীদের আগ্রহ বেশি। আইনের উল্লেখিত অংশে বলা হয়েছে, লাইসেন্স পেতে কমপক্ষে ৩০ বছর বয়সি হতে হবে। তিন বছর ধারাবাহিকভাবে এক থেকে তিন লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এসব কোনো বিধান না মেনে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন বলে তারা সমালোচনা করছেন। যদিও একই আইনে অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের জন্য নিয়মে শিথিলতার কথা উল্লেখ করছেন না।
অস্ত্র ব্যবহারের শিথিলতা নিয়ে এই নীতিমালার ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে, মন্ত্রী অথবা মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আয়করের বাধ্যবাধকতা নেই। তাদের করযোগ্য আয় না থাকলেও, অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারেন। এমনকি নীতিমালার ৩২(২) অনুযায়ী মন্ত্রী বা পদমর্যাদার ব্যক্তিদের জন্য বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই।
সমালোচনার জবাব দিয়ে নিজের ফেসবুকে আসিফ মাহমুদ এক পোস্টে বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে আমার লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র আছে। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের উপরে যেভাবে হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েক দফা তাতে রাখাটাই স্বাভাবিক। যখন সরকারি প্রোটোকল বা সিকিউরিটি থাকে না তখন নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্দেশে লাইসেন্সড অস্ত্র রাখা।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিতব্য ‘ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামে’ অংশগ্রহণের জন্য রোববার ভোর ৬.৫০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। ভোরে প্যাকিং করার সময় অস্ত্রসহ একটি ম্যাগাজিন রেখে এলেও ভুলবশত আরেকটি ম্যাগাজিন ব্যাগেই রয়ে যায়। যেটা স্ক্যানে আসার পর আমার প্রোটোকল অফিসারের কাছে হস্তান্তর করে আসি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আন-ইন্টেনশনাল। শুধু ম্যাগাজিন দিয়ে আমি কি করব? ইন্টেনশন থাকলে অবশ্যই অস্ত্র রেখে আসতাম না।’
সাবেক বিচারক ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, অস্ত্র বহন করার ক্ষেত্রে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন অনুসরণ করতে হবে।
এ আইনে বলা হয়েছে, অস্ত্র মানেই হলো অস্ত্রের যেকোনো অংশ। সে ক্ষেত্রে অস্ত্রের গুলি বা ম্যাগাজিনও অস্ত্রের মধ্যে পড়বে। এটি বিমানে বহন করতে পারবে না। অস্ত্রের লাইসেন্স অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবস্থানভেদে কিছু বিধান শিথিলযোগ্য থাকলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বা বিমানবন্দরে বহনের ক্ষেত্রে সবার জন্য একই বিধান। এখানে কেউ মন্ত্রী-এমপি হলে বহন করতে পারবেন এবং সাধারণ মানুষ বহন করতে পারবেন না, তেমনটি নয়।
তিনি বলেন, বিমানবন্দর অতিক্রমের সময় উপদেষ্টা সজীব মাহমুদ ভূঁইয়া ভুলক্রমে ম্যাগাজিনটি ব্যাগে চলে আসার কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে আইনের বিধান হলো-ভুলটি প্রমাণ করতে হবে যে, আসলেই সেটি ভুলক্রমে হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ বলেছেন, এটি বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ধরা না পড়ে অন্য দেশের বিমানবন্দরে ধরা পড়লে সেটি এমব্রেসিং বা লজ্জাজনক হতো।
ঊষার আলো-এসএ