খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসি এবং প্রো-ভিসি দুজনকেই অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আজ-কালের মধ্যেই দ্রুত সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মামলা, বহিষ্কার, অনশনসহ নানা ঘটনার পর বুধবার গভীর রাতে ইউজিসির সদস্য দুজনকে অপসারণের ঘোষণা দেন। এরপর স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে ক্যাম্পাস।
বৃহস্পতিবার বিকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আনন্দ মিছিল করেছেন। এদিকে তদন্ত ছাড়াই ভিসি ও প্রো-ভিসিকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ‘ন্যায়বিচারের পরাজয়’ বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। পাশাপাশি যে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তারাই আজ অন্ধকার রাজনীতির করালগ্রাসে বন্দি বলে জানিয়েছেন। এছাড়া ১১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭তম সিন্ডিকেট সভায় প্রো-ভিসির সব ক্ষমতা খর্ব করার পর ভিসির সঙ্গে তার দূরত্বের বিষয়টি ক্যাম্পাসজুড়েই ছিল ওপেন সিক্রেট।
অন্যদিকে কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। শেষ দফায় ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের অপসারণের কথা বলা হলেও পরে ভিসির অপসারণের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। এটা নিয়েও সেসময় ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি প্রথমদিকে আন্দোলনে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল, ১৩ এপ্রিলের পর এর পরিমাণ গুটিকয়েকে চলে আসে। কুয়েটে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। তবে তখন শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন, হল ও ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা আসতে পারছে না। এরপর ২১ এপ্রিল ৩২ শিক্ষার্থী ভিসি অপসারণের এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুয়েটের ভিসি ও প্রো-ভিসি অপসারণের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি এবং স্থানীয় আধিপত্য একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। গত বছরের ১২ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর কুয়েটের ভিসি হিসাবে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাছুদ। পরবর্তী সময়ে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি চার বছরের জন্য রাষ্ট্রপতির আদেশে ভিসির দায়িত্ব পান। তিনি দায়িত্বরত অবস্থায় কুয়েট ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের সুবিধা দিয়ে আসছিলেন। কোটেশন ও নিলাম টেন্ডারের সুবিধা পান সেই দলের নেতারা। স্থানীয় এলাকার অর্ধশতাধিক জনবল মজুরিভিত্তিক পদ্ধতিতে নিয়োগ দিয়েছেন। ৪ ডিসেম্বর কুয়েটের প্রো-ভিসি হিসাবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল আলম। তার বাড়ি ক্যাম্পাসের ৪০০ মিটারের মধ্যে। তিনি স্থানীয় হওয়ায় তার ক্যাম্পাসসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু ১১ জানুয়ারি সিন্ডিকেট সভায় প্রো-ভিসির সব ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এরপর থেকে তাদের দুজনের মধ্যে নানাভাবে দূরত্ব শুরু হয়।
এদিকে কুয়েট নিয়ন্ত্রণ করে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ আধিপত্য ধরে রাখার বিষয়ে স্থানীয় বিএনপির একাধিক গ্রুপ এবং জামায়াতের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। তবে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় বহিরাগত হয়ে যুবদল নেতা মাহাবুবসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেকেই অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে দল থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
যেভাবে শুরু ঘটনার : কুয়েটে দেড় যুগ ধরে ছাত্রদলের কোনো কমিটি বা অবস্থান ছিল না। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের কর্মীরা ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফরম ও লিফলেট বিতরণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েট ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। মিছিলকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল কর্মীদের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টির পর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষে বহিরাগতরাও জড়িয়ে পড়েন। ঘটনার সময় শিক্ষকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ঘটনার পরই ছাত্রদলের কর্মীরা সংর্ঘের পেছনে ছাত্রশিবির, ছাত্রলীগ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি অভিযোগ করলেও আহতরা বিষয়টি অস্বীকার করে নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করেন।
সংঘর্ষের পর কুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবির ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ছাত্রদের নিরাপত্তা, ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ, চিকিৎসা ব্যয় বহন, আইনগত ব্যবস্থাসহ ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ ছিল। তবে সেই আন্দোলন শেষমেশ ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র জানায়, ৬টির মধ্যে ৫টি দাবিই মেনে নেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসন শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ইন্টারনেট ও পানি বন্ধ করেছিল। বহিরাগত দিয়ে ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এসব কর্মকাণ্ডে ভিসির ইন্ধন ছিল। তাই তারা ছয় দফা দাবি থেকে এক দফা দাবিতে চলে এসেছিলেন। তারা অভিযোগ করেন, ভিসি জিয়া পরিষদের নেতা ছিলেন। তিনি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া শুরু করেছিলেন। আবার বহিরাগত যুবদলসহ অন্যান্য দলের নেতাদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাও করিয়েছিলেন।
স্বস্তি ফিরল যেভাবে : ১৪ এপ্রিল সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে সিন্ডিকেট। এ ঘটনায় পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা ১৫ এপ্রিল ছয়টি হল ভেঙে প্রবেশ শুরু করে। ২১ এপ্রিল ৩২ জন শিক্ষার্থী এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। ২৩ এপ্রিল শিক্ষা উপদেষ্টা কে আর আবরার অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সকালে আলোচনা করতে খুলনায় আসেন। পাশাপাশি ইউজিসির একটি টিমও কুয়েটে আসে। ওইদিন রাত ১টার দিকে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন ভিসি ও প্রো-ভিসি দুজনকেই অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরপর শিক্ষার্থীরা অনশন ভঙ্গ করেন। ২৪ এপ্রিল বিকালে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আনন্দ মিছিল করেন।
শিক্ষক সমিতির ক্ষোভ : বৃহস্পতিবার কুয়েট শিক্ষক সমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সভা শেষে সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ভিসি ও প্রো-ভিসিকে অব্যাহতি দেওয়ার পদক্ষেপ ন্যায়বিচারের পরাজয়ের শামিল। শিক্ষা উপদেষ্টার পাঠানো প্রতিনিধিদল এক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। আমরা একটি রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চেয়েছিলাম। তবে বর্তমানে যারা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য আন্দোলন করে আসছিল, তাদেরই আজ অন্ধকার রাজনীতির করালগ্রাসে বন্দি দেখতে পাচ্ছি।
প্রো-ভিসি যা বললেন : কুয়েটের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল আলম বলেন, আমার সব ক্ষমতা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খর্ব করা হয়েছিল। আমি গত চার মাসে কোনো কাজই করতে পারিনি। আমি অন্যের টার্গেটের জাঁতাকলে পড়েছি। আমি তদন্ত কমিটিকে বলেছি সবকিছু। আমার নামে কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারেনি। পরে তারা বুঝেছে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কুয়েট ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
ঊষার আলো-এসএ