UsharAlo logo
মঙ্গলবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্গা পূজার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

koushikkln
জুলাই ২, ২০২১ ২:২৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বাঙালী হিন্দুদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূজা হলো দুর্গা পূজা। খুবই আড়ম্বর সহকারে এবং বিগ বাজেটে শারদীয় দুর্গোৎসব হিসাবে এই পূজা পালন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে ধর্মীয় আবেগের চেয়ে উৎসবের উন্মাদনা বেশী লক্ষ করা যায়। মন্দিরের ডেকোরেশন, আলোক সজ্জা, প্রতিমার ভাস্কর্য ইত্যাদি নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তাতে এই সমস্ত শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধিত হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উপলক্ষ্য লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যায়। দুর্গা পূজা বাঙালী হিন্দুর প্রধান পূজার পরিবর্তে প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ফলে পূজার ভাব গাম্ভীর্য এখন প্রায় নেই বললেই চলে। আমার এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিলো প্রতি বছর এতো টাকা ব্যয় করে বিসর্জন দেবার জন্য প্রতিমা করার দরকার কী? মূল্যবান প্রশ্ন। তাকে বলেছিলাম তাতে কোনো অসুবিধা নেই, তবে ঐ সমস্ত শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট শিল্পকলার সাথে জড়িত শ্রমিকের জীবীকার পথ বন্ধ হয়। নূতনত্ব সৃষ্টির আবেগ থাকে না। বিসর্জনের বেদনা বুঝতে পারা যায় না। বিসর্জন জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাকে অনুুভব করি প্রতি বছর জগৎমাতাকে বিসর্জন দিয়ে। আর আগমনকে অনুভব করি প্রতিমা বানানোর সূচনা দিয়ে। বন্ধুর প্রস্তাব মেনে নিলে এতোগুলো বিষয়ের কী সমাধান আছে তার উত্তর সেই বন্ধুটি দিতে না পেরে প্রচলিত প্রথার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। কিন্তু প্রথার মূল উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে শুধু উৎসব করলে ধর্ম ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। তাই এই পূজার মূল বাণী জানা একান্ত প্রয়োজন। মন্দিরে প্রতিমা বানিয়ে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার পরে তা উপাস্য দেবতা হয়। মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় রূপ হলো উপাস্য দেবতা। সীমার মাঝে অসীমকে ক্ষণিকের জন্য আবদ্ধ করে আমরা যশ চাই, ধন চাই, মান চাই, শান্তি চাই আরো কত কিছু চাই। কিন্তু এগুলো পাওয়ার উপায় তার আবির্ভুত হওয়ার উপাখ্যানের মধ্যে রয়ে গেছে যার প্রতি আমরা নজর দিতে ভুলে গেছি। সেই উপাখ্যান এখানে একটু আলোচনা করি। দেবতারা অসুরের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, তাই স্বর্গ ছাড়া হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্বর্গ ফিরে পাবার জন্য মিটিং সিটিং করে ব্যর্থ। তখন তারা বুঝতে পারে সমবেত শক্তির প্রয়োজনীয়তা। সকল দেবতার সকল অস্ত্র সমবেত করে তা প্রদান করা হয় উদ্ভূত এক নারী শক্তির হাতে যা আদি শক্তির পরিচায়ক। সেই নারী শক্তির দশ খানা হাত। দশ হাতে দশবিধ অস্ত্র। সিংহকে বাহন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ। উদ্দেশ্য অসুর বধ, অশুভ শক্তির বিনাশ।
এই কাহিনীর ঐতিহাসিকতা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কারণ এর কোনো প্রমাণক উপস্থাপন করা এখন আর সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো বাণী প্রচারের জন্য উপাখ্যান লাগে। সেই উপাখ্যানের ঐতিহাসিক সত্যতা না থাকলেও “মোরাল অব দি ষ্টোরি” নিয়ে প্রশ্ন তোলার দরকার হয় না। এখানে খরগোশ আর কচ্ছপের একটি প্রচলিত গল্পের কথা মনে করতে চাই। সেই গল্পের “মোরাল অব দি ষ্টোরি হলো ” Slow and steady wins the race.” যারা গল্পের ঐতিহাসিকতা নিয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে চান তাদের কাছে আমার প্রশ্ন যে এই যে, খরগোশ আর কচ্ছপের দৌঁড় প্রতিযোগিতা কবে কোথায় হয়েছিল, প্রমাণক কী? গল্পটির মেসেজ এখানে প্রণিধানযোগ্য, অবশ্যই গল্পটি নয়। এক রাখাল বালক বনের ধারে গরু চরাতো। মাঝে মাঝে দুষ্টামি করে বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে লোক জড়ো করে সে মজা পেতো। একদিন সত্যিই বাঘ আক্রমণ করলো। কিন্তু তার চিৎকারে সেদিন কেউ আর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না। এই গল্পটির ঐতিহাসিকতা বা সত্যতা নির্ণয় করা যাবে না। কিন্তু তাই বলে গল্পের মেসেজ মিথ্যা হয়ে যায় না। ইংরেজি সাহিত্যে রোমিও জুলিয়েট, জিম ডেলা বিখ্যাত প্রেমিক প্রেমিকার নাম। তারা কি ঐতিহাসিক চরিত্র? কিন্তু প্রেমের বর্ণনায় তারাই শিরোনাম থাকে। সেখানে রাধাকৃষ্ণ নিয়ে শুরু হয় শালীনতাহীন আলোচনা। সনাতন ধর্ম সাহিত্য নির্ভর ধর্ম। কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রে কাব্য পরশ লাগিয়ে অনেক মেসেজ দিয়েছেন আমাদের মহাকবিরা। সেই মেসেজকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে একদল অর্ধ শিক্ষিত তার্কিকের অকারণ তর্কে হিন্দু সমাজ বিব্রত।
তাহলে মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গার অসুর বধের কাহিনীতে ফিরে আসা যাক। সেখানে দেবী দুর্গার মেসেজ ( বাণী) কী?
১. অশুভ শক্তির দমন
২. অশুভ শক্তির দমনে সংঘশক্তির প্রয়োগ
৩. অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ।
৪. নারী শক্তির আধার যা আদি শক্তি।
৫. দশবিধ ক্ষমতার রূপক অর্থে দশ হাত
৬. প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার ( সিংহ শক্তি)
সুতরাং পূজার প্রকৃত তাৎপর্য বাদ দিয়ে প্রতিমা বানিয়ে যশ দেহি, জয় দেহি, ধন দেহি, পুত্রং দেহি করতে তো শুধু বলা হয়নি। পূজার চাওয়া হোক আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণার জন্য, নারীকে জাগানোর জন্য, অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অংশগ্রহণের জন্য ইত্যাদি কারণে। এইগুলো করতে পারলেই তো আমাদের আরাধ্য দেবতা খুশী হতেন। কারণ তিনি তো তাই করতে উপদেশ দিয়েছেন। তা না করে আমরা আমরা পূজার পরিবর্তে উৎসবকে মুখ্য করে ফেলেছি। ফলে পূজা তার মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের শাস্ত্রে তো কর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কর্মকে যোগে পরিণত করা যায় কোনো প্রার্থনা ছাড়াই। কর্মী যদি শুধুই দায়িত্ববোধ থেকে কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষার পরিবর্তে কর্ম করে, যদি কর্মীর অহমিকা দূরীভূত হয় আর যদি সেই কর্ম জগতের কল্যাণে উৎসর্গ করা হয়, তবে কর্মীর কর্ম যজ্ঞস্বরূপ হয়ে যায়। আমরা আড়ম্বর করে পূজা করছি। কিন্তু পূজার বাণী জীবনে প্রয়োগ করছি না। যে জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ হয় না, সেই জ্ঞান নিরর্থক। আমরা পূজার বাণী অনুধাবন করছি না এবং বাস্তবে তা প্রয়োগ করার চেষ্টাও করছি না। ফলে পূজা শুধুই উৎসবে পরিণত হয়েছে। পরিত্রাণের জন্য বিষয়টির তাৎপর্য ও গুরুত্ব সারা বছর আলোচিত ও প্রচারিত হওয়া দরকার। দুর্গা পূজার প্রকৃত বাণী আমার লেখা কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
কবিতার নাম ” শারদ বার্তা “
দুর্গা পূজার গন্ধ ভাসে
শারদ সকালে
সন্ধ্যা হলে হারিয়ে যাই
আলোর মিছিলে।
সিংহের পিঠে বসে মাতা
দেবী দশভূজা
যুগে যুগে লহেন তিনি
বঙ্গবাসীর পূজা।
অনেক তর্ক সারা হলো
তোমার আকার নিয়ে
নিরাকারকে রূপ দিয়েছি
মনের তুলি দিয়ে।
কল্পনা আর জল্পনায়
তোমার আগমনী
বিস্মৃত আজ জগতবাসী
শারদ মর্মবাণী।
শিউলি ফুলের মিষ্টি হাসি
সকালেতে ঝরে
শিশির কণায় পরিস্নাত
রূপটি নাহি ধরে।
কাশের বনে মৃদু হাওয়া
বিকালেতে বয়
আকাশেতে মেঘের ভেলা
খন্ডে খন্ডে ধায়।
এমন দিনে মা জননী
আসেন আমার ঘরে
সংঘবদ্ধ হওয়ার বার্তা
পৌঁছে দেবার তরে।
যুদ্ধ চলে যুগে যুগে
সুরে আর অসুরে
তোমার আমার সবার মাঝে
অন্তরে ও বাহিরে।
সেই যুদ্ধ জয়ের জন্য
মন্ত্র দিলেন তিনি
ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
এই হলো তার বাণী।
সম্মিলিত রূপের তরে
হলেন দশভূজা
দেবী দুর্গা শিক্ষা দিলেন
একতারই পূজা।
এছাড়া দুর্গা পূজার উপাখ্যানকে হাল আমলে অনেকে আর্য অনার্যের দ্বৈরথ বলে তা পরিহার করার কথা বলে থাকেন। তাদের বক্তব্য বাঙালীরা অনার্য বংশ সম্ভূত। সুতরাং এ পূজা তাদের জন্য অবমাননাকর। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী দুর্গা আর্য কন্যা বটে, কিন্তু তিনি অনার্য দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের স্ত্রী। দুর্গা পূজায় সকলের উপরে তাঁরই ঠাই হয়। দুই পাশে থাকে তাঁর ঔরসজাত চার সন্তান। অনার্য পিতার ঔরসজাত সন্তানাদি পিতৃ পরিচয় অনুসারে অনার্য পরিচয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই দুর্গা পূজা আর্য অনার্যের একটি মিলিত স্রোতধারা। আসুন আমরা এই পূজার তাত্ত্বিক অর্থকে হৃদয়ে ধারণ করি, লালন করি এবং আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখি।

লেখক: প্রশান্ত কুমার রায়, সদস্য, ট্যাক্সেস এপিলেট ট্রাইব্যুনাল, বেঞ্চ-৪, ঢাকা।