বি এম জুলফিকার রায়হান, তালা : সুপার সাইক্লোন আম্ফান তান্ডবের প্রায় ৯ মাস অতিবাহিত হয়েছে। উপকূলীয় আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের উপর টং ঘর বেঁধে আজও অনেক পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। দুর্গত এসব এলাকায় খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট’র পাশাপাশি এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পরপর আঘাত হানা সিডর, আইলা ও আম্ফানের তান্ডবে অর্থনৈতিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত এই জনপদের হাজার হাজার পরিবার অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে। এখানকার মানুষগুলো দিনের পর দিন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। এভাবে আর কয়েক মাস চললে এই এলাকায় মানিবক বিপর্যয় নেমে আসার আশংকা দেখা দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে আশ্রয় ও কাজের সন্ধানে এখানকার মানুষদের অভিবাসী হতে হচ্ছে।
আশাশুনির শ্রীপুর গ্রামের গৃহবধু শাহানারা বেগম (৪০)। আম্ফানের তান্ডবে তাদের দু’টি বসতবাড়ি আর ধানি জমি চলে গেছে বাঁধভাঙ্গা পানিতে নতুন সৃষ্টি হওয়া খালের মধ্যে। তাদের পরিবারের আশ্রয় এখন রিংবাঁেধর উপর কাঠের তৈরী মাচার উপরে। শাহানারার স্বামী তৌহিদ দিন মজুর, সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে সোহেল রানা (১২) স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়লেও আম্পানের পর থেকে সে পিতার সাথে নদীতে মাছ ধরে। আর দুই মেয়ে আলিফা (৮) ও জুলিয়া (৬)কে পানিবন্দী জীবন থেকে নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে শ্যামনগরে চাচার বাড়িতে।
শ্রীপুর গ্রামের গফফার গাজীর স্ত্রী শাহিনা খাতুন (৪০) বলেন, আম্ফানের পর ধ্বসেপড়া বেঁড়িবাঁধ মেরামতের জন্য প্রায় ১ সপ্তাহ কাজ করে তার স্বামী সেসময় ২দফায় ১৬ কেজি চাল ছাড়া এই পর্যন্ত আর কোনও সরকারি সহায়তা পায়নি। ৪ মাস আগে কাজের সন্ধানে গফফার রংপুর গিয়ে সেখানে বিয়ে করে ঘর-সংসার পাতে। ২ ছেলে আর ১ মেয়ে নিয়ে এখন অমানবিক দিন কাটে অসহায় শাহিনা বেগমের।
কুড়িকাউনিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক ওলিউর রহমান (৫০) জানালেন, তার ওয়ার্ডে সাড়ে ১১শ’ পরিবারের বসবাস। আম্ফানের পরে ১৭৫ পরিবার এলাকা ছেলে চলে যায়। তিনি বলেন, গ্রামের ভিতর যাতায়াত করতে হলে একাধিক বাঁশের সাকো পার হতে হয়। গ্রামে রাস্তাঘাট বলতে তেমন কিছুই আর নেই।
চাকলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভিটেবাড়ি সবই নদীতে ভেঁসে গেছে। আম্ফানের পর থেকে কপোতাক্ষ নদের বেঁড়িবাঁধের উপর আমরা ২৫ জন বাসবাস করছি। সরকারি সহায়তা হিসেবে পরিবার প্রতি ২০ কেজি চাল ছাড়া আর কিছুই পাইনি। তাও ৫ দিন বাঁধ মেরামতের কাজ করার পারিশ্রমিক হিসেবে। গত ১৬ ফেব্রæয়ারি সকালে কুড়িকাউনিয়ায় বাঁধ মেরামত করতে যেয়ে ট্রলার ডুবিতে ৩ শ্রমিক মারা গেছে।
উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর নিদারুন এই অবস্থা থেকে রক্ষা করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর পক্ষে কেন্দ্রীয় পানি কমিটি, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি ও বেসরকারী সংস্থা উত্তরণ গত ২৮ ফেব্রæয়ারি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি প্রদান করে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ৬০ এর দশকে নির্মিত পোল্ডারের বাঁধগুলো সুষ্ঠুভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বাঁধের উপর ঘনঘন জলোচ্ছ¡াস ও উচ্চ জোয়ার’র আঘাত আসছে। এছাড়া অপরিকল্পিত নোনাপানির চিংড়ী চাষের কারণে বাঁধগুলো দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সিডর, সুনামী, বুলবুল, আইলার ও আম্ফানের ফলে বাঁধভাঙ্গা প্লাবনে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় প্রায় ২৭ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতাপনগর ও শ্রীউলার ৫শ’ ৬২ পরিবার এখনও বাড়ি ছাড়া। এছাড়া বিভিন্ন বেড়িবাঁধ ও সাইক্লোন সেন্টারে ২ হাজারের বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়ে এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। এঁদের অধিকাংশ পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে সাগরে, ইটের ভাটায় বা দূরবর্তী মৎস্য ঘেরে চলে গেছে। ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর কারণে আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে অন্যত্র অভিবাসি হয়েছে।
এ অবস্থায় উপকূলীয় অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য কমপক্ষে এক বছরের খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তাদের জন্য গৃহ পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা, আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ-প্লাবিত রাস্তাগুলো সংস্কার করা ও কর্মসংস্থানের জন্য দরিদ্র মানুষদের এসব কাজে নিযুক্ত করাসহ স্মরকিলিপিতে একাধিক দাবি জানানো হয়।
এবিষয়ে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরা জেলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ বিশেষ করে কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর, তালা, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব অংশের বিশেষ করে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রধান সমস্যা বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন। ধারাবাহিক প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে উভয় এলাকায় বর্তমানে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুর রহিম বলেন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত সাতক্ষীরা উপক‚ল অঞ্চলের মানুষ। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে সরকারকে এখনি নজর দিতে হবে। এছাড়া এই জেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিতে হলে অতিরিক্ত বরাদ্দ সহ বিশেষ এলাকা ঘোষনা করতে হবে। তা’ না হলে সাতক্ষীরা উপক‚লীয় অঞ্চলে মানুষের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে।