দেশের অন্তত ৩৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমে’ অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার (১ জুন) থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই কর্মবিরতিতে সবধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও বন্ধ রাখা হয়। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রত্যাহার ছাড়াও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন ও সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবিতে দেশের ৩৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে।
নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে কর্মবিরতির এই কর্মসূচি সর্বাত্মকভাবে পালন করে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমিতিগুলোও একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনের মাঠে সরব হয়। এসময় আন্দোলনকারীরা প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কর্মবিরতি চালানোর ঘোষণা দেন।
শিক্ষকরা বলছেন, এই পেনশন স্কিম বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কর্তনের মাধ্যমে শিক্ষক সমাজের মর্যাদা হনন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরাসরি উচ্চতর পদে নিয়োগ হয়, এমনকি অভ্যন্তরীণ প্রার্থীও নতুনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এতে যদি কোনো শিক্ষক উচ্চতর পদে সরাসরি বা নতুন নিয়োগ পান, তাহলে তাঁকে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ত্যাগ করে সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে হবে। এতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হবেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি পক্ষ থেকে বলা হয়, একজন অধ্যাপক বিদ্যমান ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক পান ৮০ লাখ টাকার ওপরে। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে তা নেই। তবে বর্তমানে একজন অধ্যাপক মাসিক পেনশন পান প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে তিনি পাবেন এক লাখ ১৩ হাজার টাকা। তবে যার অর্ধেক ৬২ হাজার টাকা নিজের বেতন থেকে কর্তনের জন্য পাবেন।
এছাড়া বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশন পান। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার আজীবন পেনশন পেলেও তার মারা যাওয়ার পর নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। এতে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। বিদ্যমান পেনশনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর, কর্মকর্তাদের ৬২ বছর ও কর্মচারীদের ৬০ বছর। কিন্তু সর্বজনীন পেনশনে অবসরকালীন বয়স ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এতে বিদ্যমান পেনশনব্যবস্থা সর্বজনীন পেনশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেজন্য এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
যদিও শিক্ষকদের এই সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা থাকলেও তা হয়নি। এতে সেশনজট বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি গ্রন্থাগার খোলা না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাও করতে পারছেন না।
গতকাল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব বিভাগের সব ক্লাস এবং অনলাইন ক্লাস বন্ধ ছিল। সান্ধ্যকালীন ক্লাস হয়নি। সব পরীক্ষা বর্জন এবং মিডটার্ম, ফাইনাল, ভর্তি পরীক্ষাসহ কোনো পরীক্ষা হয়নি। বিভাগীয় চেয়ারম্যান অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ এবং একাডেমিক কমিটি, সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি, প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা হয়নি। অনুষদের ডিনরা ডিন অফিস, ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। কানো সিলেকশন বোর্ডের সভা হয়নি। বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা অফিস, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখেছিলেন।
বিভিন্ন গবেষণাধর্মী সেন্টারের পরিচালকরা কোনো সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের কর্মসূচি গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন। বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষরা প্রাধ্যক্ষ অফিস বন্ধ রেখেছেন। প্রধান গ্রন্থাগারিক কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিও বন্ধ রেখেছিলেন।
ঢাবি শিক্ষকরা গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের প্রধান ফটকের সামনে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মবিরতি পালন করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালনের খবর জানা যায়।
উল্লেখ্য, গত মার্চ মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আগের চারটি স্কিমের সঙ্গে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামের একটি প্যাকেজ চালু করে। এতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জুলাই এবং এরপর নিয়োগ পাওয়া সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই ঘটনার পর থেকেই আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা।