সামাজিক হেনস্তার ভয় কাটিয়ে ধর্ষণের বিচার চাইতে দাঁড়ালেও পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয় নারীদের। এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি প্রভাবশালীদের চাপ, আইনের ফাঁক, বিচারের প্রতিটি ধাপে সময়ক্ষেপণ, মামলার দীর্ঘসূত্রতাকে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। বর্তমানে ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্নের বিধান থাকলে বিচার শেষ করতে লাগছে ৫ বছর বা তারও বেশি। সম্প্রতি মাগুরার আলোচিত শিশু ধর্ষণের ঘটনার পর সরকার ১৫ দিনে তদন্ত এবং ৯০ দিনে বিচার কাজ সম্পন্ন করার কথা বলছে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সময়ক্ষেপণের যে চিত্র তা ভয়াবহ। আদালতে ধর্ষণ মামলার স্তূপ জমে গেছে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।
এছাড়া বিয়ের প্রলোভনে কিশোরী ধর্ষণের অভিযোগে ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিলে রাজধানীর পল্লবী থানার মামলা করেন ভুক্তভোগীর মা। প্রায় এক বছর পার হতে চলছে মামলার তদন্তই শেষ করতে পারেনি পুলিশ। বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পুলিশ পরিদর্শক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, আইনে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এ আইনের মামলায় ডিএনএ রিপোর্ট, মেডিকেল সার্টিফিকেট পেতে দেরি হয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজতেও দেরি হয় ও বিশেষজ্ঞ মতামত পেতেও দেরি হয়।
অপরদিকে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর ৭ বছর আগে ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন সুতারপাড়া ইউপির বানাঘাটা গ্রামে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে জিয়াউর রহমান নামের এক আসামিকে ১৮ মার্চ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাকে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এছাড়া আসামির স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে জরিমানার টাকা আদায় করে ভুক্তভোগীর পরিবারকে দেওয়ার জন্য ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ঘটনার সাড়ে ৪ মাস পর আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। চার্জ গঠন করে বিচার সম্পন্ন করতে সময় লেগে যায় ৫ বছরের বেশি। এছাড়াও সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন আছে এমন মামলার সংখ্যা ৩২ হাজার ৯৭২টি।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম বলেন, ধর্ষণের মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত মনিটরিং করতে হবে যেন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। আদালতে সময়ক্ষেপণের যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো খুঁজে বের করে কিভাবে কমানো যায় তা ঠিক করতে হবে। আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, আদালতে এখন এ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। সিএমএমের সঙ্গে যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সভা হয় তখন বলেছি যেন আদালতে এসব মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ না করা হয়। বর্তমানে আগের তুলনায় অনেকটাই কম সময় লাগছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বা তদন্ত সংস্থার প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে। যেসব জায়গায় বিভিন্ন কারণে বিলম্ব হচ্ছে। বিলম্ব যাতে না হয় এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার প্রার্থীরা যেন বিচার পায় সেক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এবং পূর্বের যে তিক্ততা আছে সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই যুগোপযোগী ভাবেই আইনটাকে সংশোধিত করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন এবং বিচার সম্পন্ন হবে। এছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় আইন উপদেষ্টা এ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আসতেছে। সংশোধনের মাধ্যমে এই মাগুরার শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে যতগুলো জনগুরুত্বপূর্ণ ধর্ষণ মামলা, বিশেষ করে যৌন হয়রানির মামলা যেমন, ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির মামলাগুলো নতুন আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য একটা যুগোপযোগী পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইতঃপূর্বে আইন উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আমিসহ একাধিক পাবলিক প্রসিকিউটর এবং বিভিন্ন এক্সপার্টরা অংশগ্রহণ করে। আমরা অনেক সুপারিশ করেছি। এক্ষেত্রে মাননীয় আইন উপদেষ্টা সম্মতিও দিয়েছেন এবং বলেছেন, যে এগুলো সংশোধন হওয়া দরকার। কাজেই আমি আশাবাদী যদি আমাদের সবার সুপারিশ অনুযায়ী নতুন আইনে নতুন ধারাগুলো সন্নিবেশিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো রয়েছে সেই বিষয়গুলো নতুন আইনে প্রতিস্থাপিত হলে একটি মামলার বিশেষ করে ধর্ষণ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করা, মামলার বিচারিক আদালতে যাওয়া, পরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, যদি কোনো বিচারক কিংবা তদন্ত কর্মকর্তা কিংবা এ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির প্রমাণ পায় সেক্ষেত্রেও আইনে তাকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়েছে। আমরা সংশোধিত নতুন আইনের অপেক্ষায় আছি। সংশোধিত আইন মাগুরার যে শিশু ধর্ষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে তার মামলার বিচারের মাধ্যমে এই আইনটা প্রয়োগ করতে পারব বলে আশা করি।
ঊষার আলো-এসএ