ঊষার আলো রিপোর্ট : পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের নামে প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসুমার দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। কিন্তু আড়ালেই ছিল একের পর এক প্রকল্প প্রস্তাবেই দুর্নীতির বিষয়টি। খেয়ালখুশিমতো ধরা হয়েছিল বিভিন্ন পণ্যের দাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের পর বছর এমন ঘটনা ঘটলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির নেই। ফলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল তাদের শাসনামলজুড়েই।
সূত্র জানায়, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একটি প্রকল্প প্রস্তাবে একেকটি বালিশের দাম ধরা হয় ২৭ হাজার টাকা, বালিশ কাভারের দাম ২৮ হাজার টাকা। আবার একজন ক্লিনারের মাসিক বেতন ধরা হয়েছিল ৪ লাখ টাকা। আরেকটি প্রকল্পে একটি স্যালাইন স্ট্যান্ডের দামই ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা। এভাবে বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাবে প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন পণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম ধরা হয়। এসব প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে কোনো কোনো সময় চিহ্নিত হয়। আবার অনেক সময় নানা ফাকফোঁকরে পার পেয়ে যায়। নদী ড্রেজিং প্রকল্পে সাইনবোর্ড স্থাপনে একেকটির খরচ ২ লাখ টাকা। কফি ও বাদাম চাষে ১০ কর্মকর্তার বিদেশ সফর, সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ২ কোটি টাকায় বাংলো নির্মাণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে ৪ কোটি টাকার অডিও-ভিডিও এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাবও এসেছিল। ফলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো-ভুল করে এমন প্রস্তাব যায় পরিকল্পনা কমিশনে। পরে সমালোচনা ও পরিকল্পনা কমিশনের চাপের মুখে এসব প্রস্তাব থেকে সরেও আসে। কিন্তু যারা ভুল করেছেন বা ইচ্ছা করে এমন সুযোগ রেখেছেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। তবে কোনো কোনো প্রকল্পে একজন কর্মকর্তাকে বদলি করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আবার কোনোটিতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চললেও তা বেশিদূর এগোতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কেননা বিষয়গুলো জানা সত্ত্বেও সেগুলো খতিয়ে না দেখে বরং যারা তথ্যগুলো প্রকাশ করছিলেন তাদেরই দায়ী করা হতো। বলা হতো সরকারের দুর্নাম করা হচ্ছে। এক কথায় যে বার্তা নিয়ে এলো সেটি পছন্দ না হলে তাকেই গুলি মারা হতো। বার্তাটির সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হতো না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমস্যাটা এত ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল যে, এটা সংশ্লিষ্টদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এসব কাজ যেসব কর্মকর্তা করতেন না তারা টিকতে পারতেন না। অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হতো। যাতে ডিস্টার্ব না করেন। অর্থাৎ অনিয়মটাই ছিল নিয়ম। তাই এখন এসব দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে প্রবণতা কমবে।
বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে দেওয়া ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রস্তাব করা ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পে বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা খুঁজে পায় পরিকল্পনা কমিশন। এক্ষেত্রে একটি বালিশের দাম যেখানে সাড়ে ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা, সেখানে ধরা হয় ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। বালিশের কাভারের দাম যেখানে ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছিল ২৮ হাজার টাকা করে। একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের দাম যেখানে সম্ভাব্য বাজার মূল্য ১০০-২০০ টাকা হওয়ার কথা, সেখানে ধরা হয় ৮৪ হাজার টাকা। ৩০০-৫০০ টাকার রেক্সিনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছিল ৮৪ হাজার টাকা। স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম যেখানে ২০-৫০ টাকা হওয়ার কথা সেখানে প্রস্তাব আসে ৩৫ হাজার টাকা। ২৫০-১০০০ টাকা দামের কটন তাওয়েলের দাম ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৮৮০ টাকা। এছাড়া ৫ এমএল সাইজের টেস্টটিউব-গ্লাস মেডের আনুমানিক বাজার মূল্য ১৫ থেকে ৫০ টাকা হলেও প্রস্তাব করা হয় ৫৬ হাজার টাকা। এ রকম অনেক খাতেই অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল। ব্যাপক লুটপাটের আশঙ্কায় এ রকম ১২টি পণ্যের উদাহরণ দিয়ে প্রকল্পটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। যারা এ রকম প্রস্তাব দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এর আগে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা’ প্রকল্পে সাপোর্ট স্টাফদের অবিশ্বাস্য বেতন প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। অফিস সহায়কের বেতন প্রতি মাসে ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা এবং ক্যাড অপারেটরের বেতন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, বিদেশি পরামর্শকের মাসিক বেতন ধরা হয় ২৫ লাখ টাকা, যা গড়ে ১৬ লাখ টাকা। এসব ব্যয় অত্যধিক বলে প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। পরে সংশোধনী প্রস্তাবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কারও বিরুদ্ধে। একই অবস্থা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন প্রকল্পেও। এতে স্যালাইন ঝোলানোর জন্য স্ট্যান্ডের দাম ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা। আর লুকিং গ্লাসের দাম ২০ হাজার টাকা। এ রকম অতিরঞ্জিত ব্যয়ের প্রস্তাব আসে পরিকল্পনা কমিশনে।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) এসব অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবনা নিয়ে চরমভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দায়ীদের বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রকল্প প্রস্তাবেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির পাঁয়তারা চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে একেকটি পালস অক্সিমিটারের (শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ যন্ত্র) দাম ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যার বাজার মূল্য ১৫শ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া প্রতিটি ফেস মাস্কের দাম ধরা হয় ১৫ হাজার ৬০০ টাকা, যার বাজার দর ৫ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এছাড়া আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক দাম। পরে এ প্রকল্পের ধীরগতিসহ নানা বিষয়ে তদন্ত করে শাস্তির নির্দেশও দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সাবেক সচিব আলী নূর শনিবার বলেন, আমি দায়িত্ব পালনকালীন এ রকম ঘটনায় কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এছাড়া আমার সময়ে এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি অধিদপ্তর দেখে। তারাই বলতে পারবে।
আরও আছে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণসংক্রান্ত একটি প্রকল্পে অডিও-ভিডিও এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে ৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয় নির্বাচন কমিশন। যোগ্য জনবল থাকা সত্ত্বেও ৪ লাখ টাকা মাসিক সম্মানিতে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। সেই সঙ্গে ছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক সম্মানিতে পরামর্শক নেওয়ার প্রস্তাবও। ‘ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও জাতীয় পরিচিতি সেবা প্রদানে টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে এ চিত্র খুঁজে পায় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। কফি-বাদাম চাষে প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর, খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশ সফর, ঘাস চাষ শিখতে বিদেশ সফর, পুকুর খনন শিখতে বিদেশ সফরসহ নানা অজুহাতে বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব যেন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এসব ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি তুলে ব্যয় কমিয়ে দেয়। কিংবা বাতিলও করে দেওয়া হয়। কিন্তু যারা প্রস্তাব দেয় তাদের কিছুই হয়নি।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, এ রকম মাত্রাতিরিক্ত পণ্যের দাম ধরাটা অবশ্যই দুর্নীতি। তবে আমি দেখেছি সবার মধ্যে দায় এড়ানোর একটা প্রবণতা আছে। যেমন যারা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করেন তারা সাধারণত নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তা হন। ওই সংস্থা প্রধান মনে করেন এটা দেখার কী আছে। কখনো কোনো সমস্যা হলে ওই কর্মকর্তারাই দায়ী হবেন। আবার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাবেন প্রকল্প তৈরি করেছে সংস্থা। তাই দায় তাদের। এভাবে যখন পরিকল্পনা কমিশনে আসে তখন কমিশন কিছু গৎবাঁধা কথা বলে সুপারিশ দিয়ে দেয়। এভাবে সব সংস্থার প্রধানরা দায় এড়াতে চান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংস্থাপ্রধান যেমন দায়ী, তেমনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবও মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবে দায়ী। আবার পরিকল্পনা কমিশন যদি না ধরে তারাও দায়ী। কিন্তু বাস্তবতা হলো দুর্নীতিকে উৎসাহ দিতে সব পক্ষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এর আগে বলেন, এ রকম অতিরিক্ত ব্যয় বা ভুল ব্যয় প্রস্তাব কখনো কাম্য নয়। যারা এ রকম ব্যয় প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কেননা এটা করা না গেলে বারবার একই ভুল হতেই থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যাতে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। আমার জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করেছি।
ঊষার আলো-এসএ