ঊষার আলো রিপোর্ট : মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকায় দুজন উপপরিচালক ও একজন হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। রোববার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উপপরিচালকদের এবং সোমবার মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজারকে বরখাস্ত করা হয়। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক (প্রশাসন) আবুল কাশেম ও বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম এবং প্রধান কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার মো. শাহজাদাকে বরখাস্ত করা হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে গত বছর ২২ অক্টোবর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ওয়াহেদুজ্জামানকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তাদের সম্পৃক্ততা পেয়ে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছেন। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের রোববার সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন (যুগ্মসচিব) জাকিয়া আফরোজ বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তারা সরাসরি জড়িত। এমনটাই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। উপরিচালকরা নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা সে কারণে মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, তাকে অধিদপ্তর থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানান, উপপরিচালক আবুল কাশেম এবং হিসাব সহকারী কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার মো. শাহজাদা দেশের সব জেলার ডিডিদের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থী সংগ্রহ করে। তৃতীয় শ্রেণির পদের জন্য ১২ থেকে ১৫ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণির পদের জন্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে চাকরি প্রত্যাশীদের সঙ্গে কন্টাক করেন। অনেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিমও দিয়েছেন। আবার কারও কাছ থেকে চেক নিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে কন্টাক করে টাকা যৌথ অ্যাকাউন্টে রেখেছেন। নিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে মুহূর্তের মধ্যে টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেবেন।
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ-মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে ওই পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। ভেস্তে যায় তাদের বদলি বাণিজ্যের পরিকল্পনা। বরখাস্ত হওয়া উপপরিচালক (প্রশাসন) আবুল কাশেমের একান্ত অনুগত কর্মচারী হিসাবরক্ষক কাম ক্রেডিট সুপারভাইজার শাহজাদা। সে অন্য শাখার কর্মচারী হলেও আবুল কাশেমের কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন। শাহজাদা নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরির সময় ছিলেন এবং বগুড়া জেলার উপপরিচাক মো. শহিদুল ইসলামকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান।
সূত্র আরও জানায়, তারা প্রায় ৫৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে ছক কষেছিল। কিন্তু বিধিবাম। তাদের সে আশা আর পূরণ হয়নি। তাদের টাকা দিয়েছেন এমন কোনো অভিযোগ বা আবেদন কি কেউ করেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, অপেক্ষা করুন। অনেক কিছু বের হবে। আবুল কাশেম গংয়ের অজানা অনেক তথ্য পাবেন। ধৈর্য ধরুন।
সূত্র আরও জানায়, আবুল কাশেম উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করায় অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ বদলি, জেলা ও উপজেলার বদলি, অধিদপ্তরের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, গ্রেডেশন লিস্ট তৈরি, বাসা বরাদ্দ, যানবাহনের জ্বালানি, আপ্যায়ন, ভ্রমণ বিল, দৈনিক ভাতা, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত লোনসহ সবকিছুতেই কমিশন নিতেন। এছাড়া আবুল কাশেম এক সময় উপপরিচালক হিসাবে ভিজিডি শাখায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন দেশের অধিকাংশ এনজিও’র মালিকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ১০-১৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম নিয়ে ভিজিডির কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব বণ্টন করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভিজিডি কাজে এখনো পার্সেন্টেজ নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বলে জানা গেছে। অবৈধ উপার্জনে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। তাকে অধিদপ্তরের সবাই সুপারবস এবং বিগবস বলে ডাকেন। কারণ ক্যাডার কর্মকর্তারা মহিলা অধিদপ্তরে দায়িত্ব পালন শেষে আবার অন্যত্র বদলি হয়ে যান। কিন্তু অধিদপ্তরের স্থায়ী কর্মকর্তা হিসাবে আবুল কাশেমের কোনো বদলি নেই। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবুল কাশেমের সব অপরাধের শেল্টারদাতা হচ্ছেন ক্যাডার কর্মকর্তারা। সে সব অপকর্ম তাদের জ্ঞাতসারেই করতেন। কিন্তু তারা সব সময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর কোনো ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত ক্যাডার কর্মকর্তারাই করেন। সুতরাং তাদের নাম আর অপরাধীর তালিকায় আসে না। এটা আমাদের দেশের জন্য একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৫০৪টি পদে জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি। ২৭ জন ডে-কেয়ার ইনচার্জ, ৬০ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এবং ৪১৭ জন অফিস সহায়ক নিয়োগ দেওয়ার কথা। গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ২০টি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা প্রবেশ করার পর হঠাৎ জানানো হয়, পরীক্ষা নেওয়া হবে না। কোনো কারণ উল্লেখ না করে এবং পূর্বঘোষণা ছাড়াই এমন ঘোষণায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বরখাস্ত আদেশে বলা হয়, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর ২(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের অপরাধ করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৩৯(১) ধারা এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৭-এর ১২(১) বিধি অনুযায়ী আবুল কাশেম ও মো. শহিদুল ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২১ এপ্রিল থেকে এ বরখাস্ত কার্যকর হয়েছে। বরখাস্ত অবস্থায় তারা খোরপোষ ভাতা পাবেন।
ঊষার আলো-এসএ