বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ নিশান বাড়ীয়া এলাকায় এক যুবকের ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে ধর্মান্ধ কতিপয় মুসলমান উগ্রপন্থিরা হিন্দু বাড়ীতে হামলা, খড়ের গাদায় অগ্নি-সংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
সোমবার রাত ১০ টার দিকে মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের আমুরবুনিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এখানে তিনশ’র বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস করে। দীর্ঘদিন ধরে এখানকার হিন্দু মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে এক সাথে বসবাস করে আসছেন। হটাৎ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা ভাংচুরের ঘটনায় তারা অনেকেই হতবাক হয়েছেন।
সম্প্রতি এই গ্রামের কৌশিক বিশ্বাস নামে এক হিন্দু যুবকের ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে বাড়িঘর মন্দিরে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় নিরব আতংঙ্ক বিরাজ করছে হিন্দু কমিউনিটিতে। নতুন করে যাতে আর হামলা ভাংচুর না হতে পারে সেজন্য ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের পুলিশী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সাদা পোষাকে এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশের একাধিক দল।
মঙ্গলবার ওই এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে গ্রামের হিন্দু সম্পদায়ের মানুষের সাথে কথা বলে ও ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, আমুবুনিয়া গ্রামের হিন্দু পাড়ায় টিনশেডের একচালা একটি সার্বজনীন দূর্গা মন্দির। হামলায় মন্দিরের টিনের চালা একদিকে ঝুঁকে গেছে, বেশকিছু টিন মাটিতে পড়ে রয়েছে। মন্দিরের সামনে কিছু মানুষ অবস্থান নিয়েছে। তারা মন্দিরটি দেখছেন আর অবাক হচ্ছেন। চোখে মুখে চাপা আতংঙ্ক। মন্দিরের পাশে আরেকটি টিনের চালায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা কিছুটা মুখ খুলতে শুরু করেন।
এলাকার মনিময় মন্ডল বলেন, আমাদের গ্রামের কৌশিক ভারতে বসে ধর্ম অবমাননা করে একটি পোস্ট দেয়। এই বিষয়টি আমরা জানতে পেরে গত সোমবার স্থানীয় ভাবে বসাবসি করি এবং কৌশিক ঘটনার জন্য প্রকাশ্য ক্ষমা চায়। তার বাবা ধর্ম নিয়ে লেখার জন্য তার ছেলেকে সবার সামনে মারধর করেন। বিষয়টি এখানে মিটে যায়। অথচ, সন্ধ্যার পরে হঠাৎ করে এলাকায় দলে দলে মিছিল শুরু করে। এতে আমরা ভীত হয়ে পড়ি। এ সময়ে আমরা অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে গা ঢাকা দেই। রাতে এসে তারা মন্দিরে হামলা ভাংচুর করে। যে অপরাধ করেছে তার বিচার আমরা চাই। যারা মন্দিরে হামলা করেছে তাদের বিচার চাই।
অনুকুল গাইন নামে আরেকজন বলেন, সন্ধ্যার কিছু আগে ৫/৬টি মোটরসাইকেলে এলাকার কয়েকজন এখানে আসে। সন্ধ্যার পর বিপুল পরিমান মানুষ একেরপর এক মিছিল জড়ো হতে থাকে। মিছিল থেকে হিন্দু বিদ্বেষী নানা স্লোগান দিতে থাকলে তখন আমরা ভয় পেয়ে যাই। সবার হাতে লাঠিসোটা ও দেশিয় অস্ত্র। আশে পাশের সব লোকদের বাড়ির লাইট নিভিয়ে ফেলতে বলি। আমরা সব ধর্মের মানুষ এখানে মিলেমিশে থাকতে চাই। আমরা যাতে সবাই আগামীতে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারি সেই দাবি জানান প্রশাসনের কাছে।
এলাকার বৃদ্ধ মো. আবুল কালাম হাওলাদার বলেন, এই গ্রামে ৪৩ বছর ধরে বসবাস করছি। মন্দিরের পেছনেই আমার বাড়ি। হিন্দু মুসলমান মিলেই আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। হিন্দুদের পুজার সময় আমরা তাদের পাশে থাকি। কোনদিন তাদের সাথে কারও বিবাদ হয়না। এলাকার একটি হিন্দু ছেলে কি লিখেছে তা জানতে পেরে তা নিয়ে বসাবসি করে মীমাংসা হয়েছে। বৈঠকে থাকা মালেক গাজী নামে এলাকার সাবেক এক মেম্বার ওই ঘটনার জন্য ছেলেটিকে কয়দিন এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেয়ার পরামর্শ দেয়। কেননা ওই ফেইসবুকে লেখালেখির জন্য ধর্মপ্রাণ অনেক মুসল্লি তোমার উপর ক্ষুব্দ আছে তারা তোমাকে মারতে পারে বলে সতর্ক করি। রাতে তারাবির নামাজের সময় এলাকায় চারিদিক থেকে দলে দলে মিছিল আসছে। এরপরে হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় আমি হতবাক হয়েছি। আমরা হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে একত্রে বসবাস করব। এসব কি? ছেলেটা যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে তার বিচার আইন করবে। বাইরের এলাকার মানুষ এখানে এই হামলা ভাংচুর করেছে। এই ঘটনার বিচার আমি চাই। শুনেছি মোংলা থেকেও কিছু উগ্রবাদীরা এখানে এসেছে।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মোংলা সার্কেল) আসিফ ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে একদল বিশৃঙ্খল জনতা বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। ঘটনা জানার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অভিযোগ ওঠা যুবক কৌশিককে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে নেয়। খবর পেয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে আসেন। অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। এখানকার পরিস্থিতি এখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুলিশ এই ঘটনা তদন্ত শুরু করেছে। যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিবে।
মোরেলগঞ্জ থানার নবাগত ওসি সাইদুর রহমান বলেন, আমুরবুনিয়া গ্রামে হিন্দুবাড়িতে হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে ও এজাহার নামীয় মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই হামলার সাথে যারাই জড়িত থাকুক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। এই ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে থানায় পৃথক দুটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
(ঊষার আলো-এফএসপি)