ঊষার আলো প্রতিবেদক : একজন নারী এতো ছুটতে পারে! বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে যেমন তার পদধূলি, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেও তার ছুটে চলা। বাংলাদেশকে শুধু বিদেশে পরিচিতো করানোই নয়, দেশের পাসপোর্টকে এগিয়ে নিতে চান সম্মানের পর্যায়ে। মনের আনন্দে যেমন ঘুরতে ভালোবাসেন, ঠিক তেমনি সবুজ পাসপোর্টকে সারা বিশ্বে পরিচিতো করাতেও তৎপর তিনি।
বলছি কাজী আসমা আজমেরী সম্পর্কে যিনি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে অনেকটা যুদ্ধ করেই ১১ বছরে ১১৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। নারী হয়েও তিনি প্রথম বাংলাদেশী তরুনী যিনি শতাধিক দেশ ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
গল্পের শুরু ২০০৯ সালে। প্রতিটি মেয়ে যখন শাড়ি-চুড়ি-গহনা কিনে জমা করে আজমেরী তখন জমানো গহনা বিক্রি করে ভ্রমণ শুরু করেন। তারপরে চাকরি করে টাকা জমিয়ে প্রত্যেক দেড় বছরে ৬ মাস ভ্রমণ করেন। ২০১২ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে থাকার পরও নিজের দেশকে ভালোবেসে পরিবর্তন করেননি নিজের নাগরিকত্ব।
আজমেরী নিজেকে অনেক ধন্য মনে করে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে তার জন্ম এবং সেটাকে তিনি সবাইকে গর্বের সাথে পরিচিত করিয়ে দেন। নাগরিত্ব চেঞ্জ করে তার দেশকে অসম্মান করার কোন মানে হয় না। এজন্যই বাংলাদেশের দুর্বল পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ভ্রমণ করেছেন, প্রমাণ করছেন বাংলাদেশীরাও ভ্রমণ করতে পারে, আর ১৮ কোটি মানুষকে উৎসাহ যুগিয়েছেন, সবুজ পাসপোর্ট দুর্বল নয়, আপনিও পারেন ভ্রমণ করতে সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে।
তবে কাজটি খুব একটা সহজ ছিল না তার জন্য। তাকে ২০১০ সালে ৯ই ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ২৩ ঘণ্টা ইমিগ্রেশন জেলে থাকতে হয়েছে। রিটার্ন টিকেট, হোটেল বুকিং ছিল না বলে এইভাবে তাকে হেরাজমেন্টের শিকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশ বলে তাকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছিল প্রথমে বুঝতে পারেননি। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সাইপ্রাসে একই বছর মে মাসের ৩ তারিখে। যখন ২৭ ঘন্টা ইমিগ্রেশন জেলে রাখা হয় গলাধাক্কা দিয়ে। জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের তারা সম্মান করে না। বাংলাদেশ সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই ইমিগ্রেশন মনে করে, বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে তাদের দেশে থেকে যাবে। তাদেরকে ভুল প্রমাণিত করার জন্যই বাংলাদেশী পাসপোর্টে বেশি বেশি বিদেশ ভ্রমণ করতে হবে। সময় সুযোগ পেলে বাংলাদেশিদের ভ্রমণপিয়াসু মনও উড়ে বেড়ায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের মতো অনেক অনুন্নত দেশের মানুষও ভ্রমণপিয়াসু আছে। যারা বিশ্বকে দেখতে চায়। কিন্তু ভিসা জটিলতা তারা সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনা। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই তরুণী। মাত্র ৩১ বছরে ১১৫টি দেশ এবং তার ৯০তম দেশ থেকেই তার ভিসা জটিলতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার পরেও তিনি কীভাবে বিশ্বভ্রমণ করলেন তা শোনাতে চান পৃথিবীর মানুষকে। ফিলিপিন থেকেই শুরু করেন তার সেই গল্প বলা, অনুপ্রাণিত করার জন্য লেগে যান “ঞৎধাবষরহম রং ভঁহ ধিু ঃড় ষবধৎহ” এই শ্লোগানে বিশ্বের প্রায় ১৮টি দেশে ৩০,০০০ স্টুডেন্টকে নিজের গল্পের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছেন। ইচ্ছা ছিল মুজিববর্ষে ১ লক্ষ ছেলেমেয়েকে অনুপ্রাণিত করবেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্র-ছাত্রীদের। করোনা ভাইরাসের কারণে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। কোভিডের প্রাক্কালে বাংলাদেশে বাবা মার সাথে দেখা করতে এসে আটকে পড়েন। ফলে নিউজিল্যান্ড রেডক্রসের চাকরিটাও হারাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাতে তিনি দমে যাননি। বাংলাদেশের থাকায় করোনার বছরে চেষ্টা করেছেন দেশের মানুষের সাথে ও তার প্রিয় শহর খুলনার মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতে। ৫০০ পরিবারকে করোনাকালীন খাদ্য সহায়তাসহ সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন।
অফিস ম্যানেজমেন্ট করতে করতে জীবনে টাইম ম্যানেজমেন্ট টাও খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছেন তিনি। করোনাকালে বসে না থেকে, নিজের পৈত্রিক বাড়িতে গড়ে তুলেছেন “ইন্সপায়ারিং ইয়ুথ ক্লাব”। ইতিমধ্যে দোতালাটাকে চারতলায় রুপান্তর করছেন। আধুনিক লাইব্রেরী সাজানোর কাজ চলছে। ট্রাভেলারদের জন্য তৈরি হচ্ছে মিউজিয়াম। বাচ্চাদের জন্যে আর্ট স্কুল, লাইব্রেরী, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব ও ইয়থ হার্ড। যেখানে খুলনার টিনেজার ছেলেমেয়েরা তাদের গ্রুপ স্টাডি করার সুযোগ পাবে। সঙ্গে ইংলিশ মুভির মাধ্যমে ইংলিশ শেখার সুযোগ থাকবে। তার স্বপ্ন “ঋঁহ ধিু ঃড় ষবধৎহ” শিক্ষার এর মাধ্যমে বাচ্চাদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করা। শিক্ষা যেনো বাচ্চাদের কাছে বোঝা না হয়ে দাড়ায়। অনেক ফ্যান, ফলোয়ার বই ও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। আশা করছেন ঈদের পরে পুরো দমেই উন্মুক্ত করতে পারবেন ক্লাব।
আজমেরী মনে করেন, যারা নিজেকে প্রচার করতে ব্যস্ত, তারা কাজ করার সময় নষ্ট করছেন। কাজই ওই মানুষটার প্রচার করবে। আজকের কাজ, তাকে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতে। আজকের প্রতিটি মিনিটকে গুরুত্ব মুহূর্তকে ব্যবহার করা উচিত। তাহলেই প্রতিটি নারী সফলতার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবেন।