সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ‘জিয়াবাড়ি’ কালের স্মৃতি হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ এ বাড়ি পরিদর্শনে আসেন। দর্শনার্থী, স্বজন ও এলাকাবাসী ১৩০ বছরের এ দোতলা বাড়িটি অক্ষত রেখে সেটা ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন।
বাগবাড়ী গ্রামের তালুকদার পরিবারের বড় ছেলে মন্তেজার রহমান তালুকদার জানান, জিয়াউর রহমানরা ছিলেন মণ্ডল পরিবারের। তার দাদা পাশের মহিষাবান গ্রামের কামাল উদ্দিন মণ্ডল বাগবাড়ীতে এসে তৎকালীন জমিদার পরিবারের মেয়ে মিছিরুন নেছাকে বিয়ে করেন। মিছিরুন পৈতৃকসূত্রে ৫০০ বিঘা জমি পান। তাই স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতেই সংসার শুরু করেন। ওই দম্পতির সংসারে সাত ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়। ছেলেদের মধ্যে মনসুর রহমান পঞ্চম সন্তান। তিনি জাহানারা বেগম রানীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে জন্ম নেয় চার ছেলে সন্তান। দাদা কামাল শখ করে ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় নাতির নাম রাখেন জিয়াউর রহমান কমল। ‘কমল’ নামটি ছিল জিয়ার পারিবারিক ডাকনাম। জিয়া স্থানীয় বাগবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়ার সময় বাবা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনসুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। এরপর দীর্ঘদিন গ্রামবাসী ও স্বজনদের সঙ্গে জিয়ার দেখা হয়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বাগবাড়ীতে এলে আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী তাকে দেখেন।
জিয়াউর রহমানের পূর্বপুরুষরা ১৮৯৫ সালে বাগবাড়ী গ্রামে একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করেন। ১৩০ বছরের প্রাচীন বাড়িটি বর্তমানে ‘জিয়াবাড়ি’ হিসাবে পরিচিত। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে এটি দোতলা করা হয়। তারেক রহমান গ্রামে এলে এ দোতলায় বিশ্রাম নিতেন। বাড়ির প্রবেশমুখে লেখা আছে, ‘জিয়াবাড়ি, বাগবাড়ী, বগুড়া।’ বাড়ির ভেতরে পশ্চিম পাশে একটি দোতলা পাকা ঘর। ওই পাকা ঘরের সামনের দেয়ালে বাড়ি নির্মাণের তারিখ লেখা, ‘২২শে আষাঢ় ১৩০২ সন, ১৮৯৫ সাল।’
বর্তমানে জিয়াবাড়ি দেখাশোনা করেন জিয়া পরিবারের আত্মীয় রোকেয়া তালুকদারসহ অন্যরা। ঘরের ভেতরে জিয়ার আমলের একটি খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা ও সামান্য কিছু আসবাবপত্র রয়েছে। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান যে খাটে ঘুমাতেন, সে খাটের সঙ্গের বোতাম সেট করা মশারি, জমিদার আমলের কাচের গ্লাস অনেক আগেই চট্টগ্রাম জাদুঘরে রাখা হয়েছে। বাড়িটিতে রয়েছে একটি বিশেষ কক্ষ। সে কক্ষে রাখা হতো নিরাপত্তার জন্য দামি জিনিসপত্র। ঘরটির পেছনে ঘাটসহ একটি পুকুর, বাড়ির সামনের অংশে বড় পরিসরের খোলা জায়গা রয়েছে। জিয়াবাড়ির পূর্বপাশে সরোবর খালটি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে এ এলাকার কৃষিজমিতে সেচের জন্য নিজেই খনন করেছিলেন। জিয়ার স্মৃতি ধরে রাখতে বাড়িটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়নি।
জিয়া পরিবারের সদস্য প্রয়াত বাচ্চু তালুকদারের স্ত্রী রোকেয়া তালুকদার বলেন, তিনি (জিয়া) সম্পর্কে আমার চাচাশ্বশুর হন। তাকে একবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বাড়িটি দেখতে আসেন।
আত্মীয় মোজাম্মেল তালুকদারের স্ত্রী গোধুলী তালুকদার বলেন, জমিদার আজিজার পাইকারের এক মেয়ে ছিল। একটা তালুক দিয়ে কামাল উদ্দিন মণ্ডলকে ঘরজামাই রাখেন। এ বাড়িতে জিয়া ও তার অপর তিন ভাইয়ের জন্ম হয়। জিয়া রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর গ্রামের হাইস্কুলে এসেছিল; তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছেন। জিয়া পরিবারের সবাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের সঙ্গে গ্রামের সবার সুসম্পর্ক ছিল। খালেদা জিয়া এসে তাদের সবাইকে খুব আদর করতেন।
বাগবাড়ী গ্রামের মজিবর তালুকদার ও কয়েকজন প্রবীণ আরও জানান, গ্রামের কাদামাটি, পানি, জমির আইল ধরে বেড়ে ওঠা কিশোর জিয়াউর রহমান একদিন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। নিজের মেধা, মনন, ত্যাগ আর দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে এক অনন্য জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেছিলেন।
বগুড়ার ধুনটের নিমগাছী ইউনিয়নের বেড়েরবাড়ি গ্রাম থেকে জিয়াবাড়ি পরিদর্শনে আসা দুই বোন রোকসানা ও সুমাইয়া জানান, তারা জন্মের পর শহীদ জিয়ার নাম শুনেছেন। তার দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেশ এবং জনগণের জন্য তার কর্মকাণ্ডের অনেক প্রশংসা শুনেছেন। অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল জিয়া বাড়ি দর্শনের। মঙ্গলবার দুপুরে তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। দুই বোন এ বাড়ি দ্রুত জিয়া জাদুঘরে রূপান্তরের দাবি জানিয়েছেন।
নশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী রাজ্জাকুল আমিন রোকন তালুকদার বলেন, জিয়া সম্পর্কে তার ভাতিজা ও তারেক রহমান নাতি হয়। জিয়াউর রহমানের দাদা কামাল নামকরা পণ্ডিত ছিলেন। তারেক রহমান তার বাবা-দাদাদের মতো উদার ও ভালো মনের মানুষ হয়েছেন। তারেক রহমানের সহযোগিতায় তিনি গ্রামে শহীদ জিয়া রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন সেন্টার, জিয়াউর রহমান গ্রাম হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।
বগুড়া জেলা বিএনপির সহসভাপতি, গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ মিল্টন বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাগবাড়ীতে আলোচনাসভা, কুরআন তেলাওয়াত ও ড্যাবের উদ্যোগে ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্পসহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে জিয়াবাড়িকে জাদুঘরে রূপান্তর করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম জানান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গণমানুষের জন্য কাজ করেছেন। মহান এ নেতার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একইভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছেন।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা জানান, জিয়াউর রহমান শুধু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার বাড়িটি কোনোভাবেই সাধারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি তো সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা বলতেন। সে কারণে সাধারণ মানুষের মতো করেই স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে বাড়িটি রয়েছে। মূল বাড়িটি রেখে আগামী প্রজন্মের মানুষকে জিয়া সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে একটি জাদুঘর করা যায় কিনা সে বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।
ঊষার আলো-এসএ