UsharAlo logo
শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মায়ের নিষেধ না শুনে মিছিলে গিয়ে নিখোঁজ পোশাকশ্রমিক

usharalodesk
নভেম্বর ২২, ২০২৪ ১০:০৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দির গার্মেন্ট মেকানিক সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান মিলন (৩০)। সেদিনের পর থেকে গত তিন মাস তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।

১১ মাসের সন্তানসহ স্ত্রী, মা ও পরিবারের সদস্যরা ছবি বুকে নিয়ে তার ফেরার অপেক্ষায় দিনাতিপাত করছেন। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে মুক্তিপণের নামে মোটা অংকের টাকাও খুইয়েছেন। তারা মিলনকে জীবিত বা মৃত ফেরত পেতে অথবা সরকারের নিহত-নিখোঁজ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, নিখোঁজ মনিরুজ্জামান মিলন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের জোড়গাছা গ্রামের মৃত সুরুতজ্জামানের ছেলে। ২০২০ সালের প্রখর রোদে মাঠে কাজ করতে গিয়ে তার বাবা হৃদরোগে মারা যান। পরিবারের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নেন মিলন। তিনি ঢাকা ইপিজেডে ফোর ইয়াং ডায়িং নামে পোশাক তৈরি কারখানার মেকানিক বিভাগে সুপারভাইজার পদে কর্মরত ছিলেন।

গত ৫ আগস্ট ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মনিরুজ্জামান মিলনও আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। তিনি মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের পানি পান করিয়ে সহায়তা করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিখোঁজ হন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বাড়িসহ সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও মিলনের সন্ধান মেলেনি।

মা মেরিনা বেগম (৬৫) জানান, বুকের ধন মিলনের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছেন। এখনো ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মোবাইল ফোনে ছেলের দরাজ কণ্ঠে মা ডাক শুনতে চান; কিন্তু তার ছেলে আর ফিরে আসে না।

তিনি বলেন, মনে হয় ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, বা তাকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে, বা কোনো গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে শেষ বিদায় জানানোর ভাগ্যও হয়নি তার।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেরিনা বেগম বলেন, গত ৫ আগস্ট জোহরের আজানের সময় ছেলে মিলনের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। মিলন মায়ের শরীরের খোঁজ নেওয়ার পর আনন্দ মিছিলে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল; কিন্তু মা মেরিনা বেগম ছেলেকে মিছিল বা কোনো আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন।

কথা বলতে বলতে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে হু হু শব্দে কেঁদে উঠে মেরিনা বলেন, স্বামীর মৃত্যুর চার বছর পর সংসারের একমাত্র আয়ক্ষম ছেলে মিলনকে হারালেন। তিনি এত শোক কিভাবে সহ্য করবেন। ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে তার চোখের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে শোকাহত মায়ের বিশ্বাস তার প্রিয় সন্তান মিলন একদিন বাড়ি ফিরে আসবেন। তাকে মা মা বলে ডাকবেন।

বড় ভাই শিক্ষক মিল্টন মিয়া জানান, মিলনের নিখোঁজ সংবাদ পেয়ে গত ৬ আগস্ট ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেদিন সকালে আশুলিয়া থানার সামনে ফুট ব্রিজের নিচে কাভার্ডভ্যানে ছয়টি লাশ দেখতে পান। এর মধ্যে ছোট ভাই মিলনের লাশ ছিল না। সারাদিন আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল, থানা ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ করেছেন। সেখানে প্রতারকের খপ্পরে পড়েন ও তার বেশ কিছু টাকা খোয়া যায়। পরদিন চীনমৈত্রী হাসপাতালসহ আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালে ভাইয়ের খোঁজ করেন। শেষে নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন।

মিলনের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে, এমন খবরে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে যান। সেখানে ১৯টি লাশের মধ্যেও তার ভাইয়ের লাশ পাননি। এরপর তিনি আবারো প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন। তারা মিলনের লাশ ফেরত দিতে না পারলেও তার কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়।

পরবর্তীতে ছোট ভাই নিখোঁজের ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর গত তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তারা মিলনকে জীবিত বা মৃত পাননি।

স্ত্রী সবিতা খাতুন (২৪) জানান, সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে ফোনে স্বামী মিলনের সঙ্গে কথা হয়। তখন মিলন সেখানে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তখন তিনি স্বামীকে নিরাপদে ও কোনো আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করেছিলেন। এরপর আর মিলনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়নি। ওই দিন বিকালে জানতে পারেন মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, স্বামী নেই এ কথা স্মরণ হলেই যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ১৪ মাস বয়সি একমাত্র মেয়ে মারজিয়া মারিয়মকে লালন-পালন ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি দুঃশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি অবিলম্বে তার স্বামীকে জীবিত বা তার মৃতদেহ ফেরত দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। সন্তানসহ তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেও সহযোগিতা চেয়েছেন।

বগুড়ার সারিয়াকান্দির ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম শিপন বলেন, ঢাকার আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিলে গিয়ে নিখোঁজ গার্মেন্ট মেকানিক সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান মিলন গত তিন মাসে ফিরে আসেননি। তার সন্ধান পেতে ১৪ মাস বয়সি শিশুকন্যাকে নিয়ে স্ত্রী সবিতা খাতুন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি মিলনের পরিবারকে নিহত বা নিখোঁজ পরিবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, নিখোঁজ মনিরুজ্জামান মিলনের পরিবারকে সরকারি প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে। তার পরিবারকে সরকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

ঊষার আলো-এসএ