UsharAlo logo
বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিটফোর্ড হাসপাতালে পদে পদে দালাল

usharalodesk
নভেম্বর ৯, ২০২৪ ১২:৩৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : মিটফোর্ড হাসপাতাল নামে পরিচিত পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। পদে পদে দালাল, আছে চোরের উৎপাত। চিকিৎসক দেখাতে কিংবা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে সিরিয়ালে দাঁড়িয়েই দিন পার হয়ে যায়। দালাল ধরে টাকা-পয়সা দিলে কাজ কিছুটা সহজ হয়। প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালের দালালরা তৎপর থাকে রোগী ভাগিয়ে নিতে। এক্ষেত্রে কিছু চিকিৎসক দালালদের এই সুযোগ করে দেন।

কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ফরিদা বেগম (৫৫) পেটের ব্যথা নিয়ে বুধবার সকাল ৮টায় হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নিতে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ান। কাঙ্ক্ষিত টিকিট হাতে পেতে বেলা ১১টা বেজে যায়। এরপর ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর ১টায় চিকিৎসকের কাছে যান। চিকিৎসক তাকে আলট্রাসোনগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে দেখা করতে বলেন। এরপর আরও ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার টাকা জমা দিয়ে রসিদ হাতে পান। ওই রসিদ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও আলট্রাসনোগ্রাম করতে না পেরে বৃহস্পতিবার ভোর ৭টায় এসে আবার লাইনে দাঁড়ান। সকাল ১০টায় আলট্রাসনোগ্রাম করে এরপর লাইনে দাঁড়িয়ে ওইদিন দুপুর ১২টায় চিকিৎসককে দেখাতে পারেন। বাড়ি ফেরার সময় আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘সিরিয়ালেই তো দিন শেষ। চিকিৎসা আর কী করাব।’ শুধু তিনিই নন, ওই হাসপাতালে আগত প্রায় রোগীই এমন অভিজ্ঞতার শিকার হন। শত কষ্ট শিকার করে চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দালালের খপ্পরে পড়তে হয়।

জানা যায়, মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসেন। এ সময় দালাল ও চোরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন রোগীরা। টিকিট ও টাকা জমার কাউন্টারের স্বল্পতাকে ভোগান্তির জন্য দায়ী করছেন রোগীরা। দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও দালালির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। দালালরা দ্রুত টিকিট কাটা, টাকা জমা দেওয়া ও ডাক্তার দেখানোর জন্য রোগীদের কাছ থেকে টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি হলেই তারা কিছু কর্মচারীর মাধ্যমে এসব কাজ করিয়ে দেন। ফলে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে সঠিকভাবে কাজ শেষ করতে পারছেন না রোগীরা।

বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সরেজমিন ওই হাসপাতালটিতে দেখা যায়, কয়েকশ রোগী টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। সাংবাদিক উপস্থিতি টের পাওয়ার পর কিছু লোক লাইন থেকে সটকে পড়েন। সিরিয়াল অনুযায়ী টিকিট পেতেই রোগীদের ১ ঘণ্টার উপর সময় লেগে যাচ্ছে। হাসপাতালটির নতুন ভবনের ২য় তলায় বহির্বিভাগে দেখা যায়, প্রতিটি বিভাগে চিকিৎসকের রুমের সামনে লম্বা লাইন। চিকিৎসকের কাছে যেতে একজন রোগীর এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। আক্তার নামে একজন রোগীর স্বজন এ প্রতিবেদককে বলেন, ১ ঘণ্টা ধরে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের পরে এসে অনেকে ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাচ্ছেন। কিভাবে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আনসার সদস্য ও কর্মচারীদের এক থেকে দুইশ টাকা ধরিয়ে দিলে তারা সিরিয়াল ভেঙে চিকিৎসকের রুমে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন। যারা টাকা দিতে অপরাগ, তাদেরই শুধু লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

ওই ভবনের নিচতলার বারান্দায়ও দেখা যায় টাকা জমা দেওয়ার কাউন্টারে লম্বা সিরিয়াল। সেখানেও একই ধরনের অভিযোগ রোগীদের। এরপর দোতলায় উঠতেই দেখা যায়, পরীক্ষার স্যাম্পল দিতে ও রিপোর্ট পেতে রোগীদের লম্বা সিরিয়াল। হাসপাতালটির ১ নম্বর ভবনের নিচতলা ও দোতলায় রেডিওলজি অ্যান্ড ইমাজিং বিভাগের এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই ও সিটি স্ক্যান করতেও রোগীদের দীর্ঘ সারি। এভাবেই প্রতিটি ধাপে ধাপে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের।

হাসপাতালের একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বলেন, রোগ নির্ণয়ে বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালে হয় না। কিছু পরীক্ষা হাসপাতালের নিজস্ব ল্যাবে হচ্ছে। কিছু পরীক্ষা কলেজের ল্যাবে ও কিছু হাসপাতালটির পরমাণু বিভাগে হচ্ছে। বেশিরভাগ পরীক্ষা বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে হচ্ছে। ফলে হাসপাতালে ওইসব প্রতিষ্ঠানের দালালরা সব সময় সক্রিয় থাকে। বাস্তবেও তাই দেখা যায়। হাসপাতালে কর্তব্যরত ডা. গৌতম কুমার পাল নামের একজন চিকিৎসক সেবা নিতে আসা আব্দুল মজিদকে একটি স্লিপ ধরিরে রেফার করে দেন পাশের একটি ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাফির জন্য।

বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দালালদের আটকে অভিযান চালালেও অধিকাংশ দালালই অধরা থেকে যায়। আটক হওয়া দালালরা ছাড়া পেয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এদিকে প্রায়ই হাসপাতালে আগত রোগীরা চোরের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। মামলার বাদী হতে রাজি না হওয়ায় চোর ধরেও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান হাসপাতালটির আনসার কমান্ডার। তিনি বলেন, ওয়ার্ড মাস্টাররা মামলার বাদী হতে চান না, তাই চোর ধরলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আনসার সদস্যরা আর যেন দালালি না করেন এ বিষয়ে তাদের সতর্ক করে দেওয়া হবে। দালালদের প্রতিদিনই তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও সবাইকে না চেনার কারণে অনেককে তাড়ানো যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন তিন হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এত সংখ্যক রোগীর চাপ সামলানোর মতো পর্যাপ্ত ডাক্তার ও কাউন্টার নেই। শিগগিরই কাউন্টার তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো চিকিৎসক প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী পাঠালে তা খতিয়ে দেখব এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঊষার আলো-এসএ