ঊষার আলো রিপোর্ট : প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের স্বর্গরাজ্য সোনাদিয়া দ্বীপ আজ বিপর্যয়ের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারসাম্য হারানোর পাশাপাশি অবৈধ দখলদারির শিকার দ্বীপটি। গত কয়েক বছরে ১৫ হাজার একর প্যারাবন কেটে সেখানে অর্ধশতাধিক চিংড়িঘের তৈরি করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা এবং জামায়াতের কতিপয় সমর্থক।
পরিবেশবিদদের মতে, প্যারাবন ধ্বংসের কারণে শুধু সোনাদিয়া দ্বীপই নয়, আশপাশের মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপও এখন জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হুমকিতে পড়েছে।
স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়ুথ ফর ইকোলজি কনজারভেশন’-এর প্রধান নির্বাহী এসএম রুবেল বলেন, প্রকাশ্যে ১৫ হাজার একরের বেশি প্যারাবন কেটে অর্ধশতাধিক চিংড়িঘের নির্মাণ করলেও উপজেলা প্রশাসন, বনবিভাগ ও বেজা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। আমরা হাইকোর্টে রিট করেছি। এরপরও প্যারাবনে ঘের নির্মাণের জন্য এক্সকেভেটর মেশিন বসানো হয়েছে। ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবারও রাতে ৪টি এক্সকেভেটর মেশিন নেওয়া হয়েছে সেখানে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের কতিপয় নেতা এসব ঘেরের দায়িত্ব নিয়েছেন।
জানা যায়, দেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান কক্সবাজার থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মহেশখালী। এই উপজেলার অন্তর্গত কুতুবজোম ইউনিয়নের ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটি একটি খালের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়েছে মহেশখালী দ্বীপ থেকে। তিন দিকে সমুদ্রসৈকত, বালিয়াড়ি, কেয়া-নিশিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খালবিশিষ্ট প্যারাবন আর বিচিত্র প্রজাতির জলচর পাখি দ্বীপটিকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
মিলেমিশে দখল ও ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্ব
সরেজমিন দেখা গেছে, ৫০টিরও বেশি চিংড়িঘের তৈরি করতে কেটে ফেলা হয়েছে অসংখ্য কেওড়া, কালো বাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গাছ। এই ধ্বংসযজ্ঞ এখনও চলছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এর নেপথ্য রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব কবির বিন আনোয়ার, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা ও এমপি আশেক উল্লাহ রফিক।
এছাড়া এতে সরাসরি জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছে-মেহেশখালী আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরীর ছেলে মহসিন আনোয়ার ও মোস্তফা আনোয়ার চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফার ছোট ভাই মারুফুল হক, কুতুবজুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামাল, উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন, উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, কমিশনার আবু তাহের, সাবেক পৌর মেয়র মকসুদ মিয়ার ক্যাশিয়ার মঈন উদ্দিন, সাবেক এমপি আশেক উল্লাহ রফিকের ফুফির জামাই আমান শরীফ ও ফুপাতো ভাই ছাত্রলীগ নেতা শমসের, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল করিম, উপজেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
জড়িত বিএনপি নেতারা হলেন- কুতুবজুম ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আয়াত উল্লাহ সিকদার, কুতুবজুম ইউনিয় বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাসুক আলম, ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ঘটিভাংগার আলী আকবর।
জামায়াত সমর্থকরা হলেন- অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তাফার মামাতো ভাই আমির হোসেন, সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনের ছোট ভাই সাহেদ, এমপি আশেক উল্লাহ রফিকের ব্যবসায়ী পার্টনার জামায়াত নেতা সাহাদাত উল্লাহ ও নাজেম উদ্দিন।
মামলা হলেও ধরা পড়েনি কেউ
৮ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক ফাইজুল কবির বাদী হয়ে প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের নির্মাণকারী আওয়ামী লীগের ২২ নেতাকর্মীসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে একটি মামলা করেছেন। কিন্তু মামলার ৫ মাসে একজন দখলদারও ধরা পড়েনি।
দখলের সুবিধার্থে তুলে দেওয়া হয় বিট অফিস, বিচ্ছিন্ন রাখা হয় সেতু
২০১৭ সালে পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপের মুখে সোনাদিয়া থেকে তুলে দেওয়া হয় উপকূলীয় বনবিভাগের সোনাদিয়া বিট অফিস। এরপর আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে স্থাপনা নির্মাণ ও দখলবাজি শুরু করেন। মূলহোতা স্থানীয় সাবেক এমপি আশেখ উল্লাহ রফিক, সাবেক সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের ইশরায় এ বিট অফিস তুলে নেয় বনবিভাগ। এছাড়াও সোনাদিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে দখলের সুবিধার্ধে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যোগাযোগের জন্য কোটি টাকা খরচ করে একটি ব্রিজ নির্মাণ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর সেই ব্রিজে সংযোগ সড়ক করতে দেয়নি। এদিকে কবির বিন আনোয়ার ইছাবালা ফাউন্ডেশনের নামে সোনাদিয়ায় জায়গা দখল করে কটেজ ও অবকাশযাপন ঘর তৈরি করেন।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হেদায়ত উল্লাহ বলেন, বনবিভাগের বিট অফিস তুলে দেওয়ার পর থেকেই সেখানে প্যারাবন নিধন ও দখলদারিত্ব শুরু হয়। আমরা সম্প্রতি পুলিশ, নৌবাহিনী ও বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সোনাদিয়ায় আবারও বনবিভাগের ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে।
জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সোনাদিয়ার লিজ স্থগিত করা হলেও জমির দলিল এখনো বেজার (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) নামে রয়েছে। তাই আমরা বেজাকে বিস্তারিত জানাব। এছাড়া সংযোগ সেতুটি বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সোনাদিয়ায় যেতে একমাত্র ভরসা হলো সমুদ্রপথ। এ কারণে যখন-তখন সেখানে অভিযান চালানো খুব কঠিন। এরপরও আমরা অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, প্যারাবন নিধন ও অবৈধ দখলদারদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুতুবজুম ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আলী আকবর বলেন, এ ঘটনায় আমি জড়িত নই।
কুতুবজুম ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাসুক আলমও জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর দায় চাপিয়েছেন।
কুতুবজুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহেশখালী যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ কামাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গত বছর যারা সোনাদিয়ায় মাছের ঘের তৈরি করেছে, তারা এখন নেই। বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের কিছু লোকজন জড়িত। এরপরও আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। অন্য অভিযুক্তরাও নানাভাবে একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ঊষার আলো-এসএ