UsharAlo logo
শুক্রবার, ৩০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

‘শিরুই লিলি’ উৎসবের সময় কেন আবারও অশান্ত মণিপুর?

ঊষার আলো ডেস্ক
মে ২৯, ২০২৫ ৫:১৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আরও একবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। বিতর্কের সূত্রপাত ভারতের ওই রাজ্যের একটা সরকারি বাস থেকে মণিপুরের নাম ঢেকে দিতে বলার অভিযোগকে কেন্দ্র করে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি মণিপুরের উখরুলে শিরুই লিলি (এক বিরল প্রজাতির ফুল) উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানের জন্য সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু গোয়ালতাবির চেক পোস্টে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বাসের গায়ে লেখা ‘মণিপুর রাজ্য পরিবহন’ থেকে ‘মণিপুর’ শব্দটা ঢেকে দিতে বলা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

একে কেন্দ্র করেই বিক্ষোভ শুরু হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ কমিটি তৈরি করে তদন্তের কথা ঘোষণা করা হলেও তা ক্ষোভ প্রশমন করতে পারেনি।

গত সপ্তাহ থেকে মিছিল, ধর্না, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ঢুকতে না দেওয়া এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বারেবারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চল।

বিষ্ণুপুর এবং থোবাল জেলা, খুরাই, কোংবাসহ একাধিক এলাকায় বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচি লক্ষ্য করা গেছে। রাজভবনের উদ্দেশে রওনা হওয়া বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে কাঁদানে গ্যাসের সেল ব্যবহার করতে হয়েছে বলে খবর।

বিক্ষোভের জেরে চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যে দিল্লি থেকে ফেরার সময় রাজ্যপাল অজয় কুমার ভাল্লাকে বিমানবন্দর থেকে রাজভবন যাওয়ার জন্য সামরিক হেলিকপ্টারে সফর করতে হয়েছিল।

ওই রাস্তা আনুমানিকভাবে ছয়-সাত কিলোমিটার মাত্র এবং সাধারণত সড়কপথেই ওই দূরত্ব সফর করেন রাজ্যপাল।

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারি মাসে এন বীরেন সিং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে এবং এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রধান হলেন রাজ্যপাল অজয় কুমার ভাল্লা।

এই প্রসঙ্গে মণিপুরের সাংবাদিক মায়ুম শর্মা বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত সপ্তাহ থেকে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুর। একাধিক অঞ্চলে বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদী মিছিল দেখা গেছে, পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষও বেঁধেছে। এখন এই রাজ্যের রাজনৈতির কথা মাথায় রেখে, বিষয়টা কোনদিকে গড়ায় সেটাই দেখার।

যে ঘটনা ঘিরে বিতর্ক

জাতিগত সংঘর্ষের জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা মণিপুরে দুই বছর পর ‘শিরুই লিলি’ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল উখরুলে। ওই বিরল প্রজাতির ফুল ফোটে এই সময়।

পর্যটকদের উৎসাহ দিতে বছর কয়েক আগে এই মৌসুমে ‘শিরুই লিলি’ উৎসব শুরু করে ওই রাজ্যের পর্যটন বিভাগ। কিন্তু মণিপুরের পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর ওই অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল।

মায়ুম শর্মা জানিয়েছেন, এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের জন্য সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল মণিপুরের সরকারি বাসে। পথে গোয়ালতাবির চেক পোস্টে নিরাপত্তা বাহিনী ওই বাস থামিয়ে ‘মণিপুর’ শব্দটা ঢেকে দিতে বলে বলে অভিযোগ।

তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে যখন এর কারণ জানতে চাওয়া হয় তখন তারা বলে ওপর থেকে অর্ডার এসেছে।

সাংবাদিকরা রাজি না হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধ হয় এবং অনুষ্ঠানে না গিয়েই তারা (সাংবাদিকরা) ইম্ফলে ফিরে আসেন।

এরপর তারা প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ জানান এবং রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে এই ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপের আবেদনও জানানো হয়।

মায়ুম শর্মা বলেছেন, একটা রাজ্যেরই সরকারি পরিবহনের গায়ে লেখা সে রাজ্যেরই নাম কীভাবে ঢাকতে বলা যেতে পারে? মণিপুর তো ভারতের অন্যান্য রাজ্যেরই মতো। তাহলে কেন এমন আচরণ- এই প্রশ্নই ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসার পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। মেইতেই সংগঠন ‘কোঅর্ডিনেশন কমিটি অন মণিপুর ইন্টিগ্রিটি’ দাবি জানায়, রাজ্যপালকে অবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক গাফিলতি ও শান্তি রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগ জানিয়ে ওই রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, মুখ্যসচিব এবং রাজ্য পুলিশের ডিজির ইস্তফা দাবি জানিয়েছে তারা।

তাদের দাবি নিয়ে রোববার থেকে মণিপুর জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলনের ঘোষণা করে ওই সংগঠন। আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর।

রাজভবনের গেট থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে কাংলা গেটে রোববার জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ তাদের বাধা দিলে ঝামেলার শুরু। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়া হয়। পরে অভিযোগ ওঠে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জখম হয়েছেন একাধিক বিক্ষোভকারী। ওই সংগঠনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার বন্ধের প্রভাব পড়ে মেইতেই অধ্যুষিত এলাকায়।

কোঅর্ডিনেশন কমিটি অন মণিপুর ইন্টিগ্রিটি আহ্বায়ক খুরাইজাম আতৌবা বিবিসিকে বলেছেন, একটা রাজ্যের নাম ঢেকে বা মুছে দিতে বলা সেই রাজ্যের মর্যাদার পরিপন্থি। রাজ্যের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অপমান করা হয়েছে। প্রশাসন রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাই রাজ্যপাল ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিবাদ চলবে।

ওই সংগঠনের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দেয়। পূর্ব ইম্ফলের খুরাইয়ে বিক্ষোভকারী নারীদের একটা দল জেলা প্রশাসকের অফিস পর্যন্ত মিছিল করে সেখানে বিক্ষোভ দেখায়। রাজ্যপালকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়। ইম্ফল পশ্চিমেও একই চিত্র দেখা গেছে।

এরই মাঝে, সোমবার দিল্লি থেকে ইম্ফলে ফেরার কথা ছিল রাজ্যপালের। বিমানবন্দর থেকে রাস্তার দু’পাশে মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বিক্ষোভকারীরা তিদ্দিম রোডের কোকাইথেল এলাকায় জড়ো হয়ে তিন কিলোমিটার দূরে রাজভবনের দিকে মিছিল করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়।

বিমান বন্দর থেকে বেরানোর রাস্তার দু’দিকে বিক্ষোভকারীদের জমায়েত দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত ইম্ফল বিমানবন্দর থেকে সেনার হেলিকপ্টারে করে রাজ্যপালকে কাংলা ফোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়।

সাংবাদিক ডেভিড মায়ুম বলেন, বিমানবন্দর থেকে রাজভবনের দূরত্ব খুবই কম। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর ছিল যে সেনাবাহিনী ঝুঁকি নিতে চায়নি।

এখন পরিস্থিতি কী?

দিল্লিতে কোঅর্ডিনেশন কমিটি অন মণিপুর ইন্টিগ্রিটি -র প্রতিনিধি দলকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য ডাকা হয়েছিল।

বৈঠকের পর সংগঠনের তরফে প্রেস বিবৃতি জারি করে বলা হয়েছে, গোয়ালতাবির ঘটনায় মানুষের আবেগ ও দাবির কথা জানিয়েছে প্রতিনিধি দল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিকরা আশ্বাস দিয়েছেন এই প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় সরকারি পদক্ষেপের জন্য বিষয়টা নোট করা হয়েছে।

তবে বুধবার পরিস্থিতি গত কয়েকদিনের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে বলেই জানিয়েছেন ডেভিড মায়ুম। তার কথায়, গত কয়েকদিন ধরে সরকারি দপ্তর, মূলত কেন্দ্র সরকারের যে সমস্ত দফতর রয়েছে, সেখানে কর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তালা ঝোলানো হচ্ছে।

তবে আজ অপেক্ষাকৃতভাবে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবে এই রাজ্যে কোনো কিছু আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। রাজভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনে কড়া নিরাপত্তা এখনো রয়েছে।

এদিকে, রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যে সরকার গঠনের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে এনডিএ-র বিধায়কের একটা দল। তাদের কাছে ৪৪ জন বিধায়কের সমর্থন রয়েছে বলে তারা দাবি করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেইতেই সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বলেছেন, শিরুই লিলি উৎসবের উদ্দেশ্য ছিল মেলবন্ধন। কিন্তু তা হয়েছে কি? একবার ভেবে দেখুন তো কাশ্মীরের কোনো সরকারি বাসের গা থেকে যদি নামটা মোছার কথা বলা হতো? সরকার কি মেনে নিত? কাশ্মীরের মতোই কি মণিপুর গুরুত্বপূর্ণ নয়? তাহলে মণিপুরের বিষয়ে সরকার উদাসীন কেন?”

ওই সম্প্রদায়েরই আরও এক বাসিন্দা অন্য অভিযোগ তুলেছেন। তার কথায়, গত দুই বছরে মেইতেইদের কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা কারও অজানা নয়। আসলে আমাদের কথা কেউ ভাবে না।

কুকি ওমেন অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটস-এর সভাপতি নাইনেইকিম মনে করেন, রাজ্যের নাম ঢেকে দেওয়ার কথা বলা রাজ্যকে অপমান করার সমান।

তিনি বলেছেন, মণিপুরের নাম ঢাকতে বলার মানে রাজ্যকেই অপমান করা। এটা সমর্থন করা যায় না। আর নিরাপত্তা বাহিনীই যদি এমন আচরণ করে, তা হলে কী বলার আছে।

অন্যদিকে, কুকিদের পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। কিম বলেছেন, অমানবিক আচরণ করা হয়েছে কুকিদের প্রতি। তাদের পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়।

ঊষার আলো-এসএ