UsharAlo logo
মঙ্গলবার, ৩রা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার ঘোষণায় ভাস্বর কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র

ঊষার আলো রিপোর্ট
জুন ১, ২০২৫ ৪:৩১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে দেশের রেডিওগুলোয় ভেসে আসে-‘আমি মেজর জিয়া বলছি।’ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকেই জাতির জীবনে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে এই মেজর জিয়াউর রহমানের। সেখান থেকে দেওয়া ঘোষণাগুলো বাঙালির জাতিসত্তা, বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সার্বভৌম অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও এই বেতারকেন্দ্রের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি ঐতিহাসিক এই স্থানটিকে। কেবল স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে রয়েছে বেতারকেন্দ্রটি। অবহেলায় পড়ে আছে বেতারকেন্দ্রের ‘১১১’ নম্বর কক্ষটিও। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে ঐতিহাসিক কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রকে স্মরণীয় করে রাখতে বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পালটা কর্মসূচির কারণে সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি বিএনপি।

চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর শায়েস্তা খান বলেন, ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট নাগাদ জিয়াউর রহমান তার অবিনশ্বর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle. Bangladesh is independent. We have waged war for the libreation of Banglsdesh. Everybody is requested to participate in the liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from the occupation of Pakistan Army. Inshallah. victory is ours. (অর্থাৎ, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং লিবারেশন আর্মির কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং সবাইকে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। আমরা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ শুরু করেছি। সবাইকে আহ্বান করছি, যার যা কিছু আছে তা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন। আমাদের এই দেশকে পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। ইনশাআল্লাহ, বিজয় আমাদের।) ওই দিন দুপুরে আমি রেডিওতে ভাষণটি শুনতে পাই। তখন আমি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের লেকচারার হিসাবে কর্মরত ছিলাম।’

মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রুপ কমান্ডার শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘শহীদ জিয়ার দ্বিতীয় ভাষণটিও প্রচার করা হয়েছিল কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে। ওই ভাষণে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের গুরুত্ব অনুধাবন করে পরবর্তী ভাষণে তিনি কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন। তৎকালীন সময়ে আমি পাকিস্তানের করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় বিবিসিতে সংবাদপরিক্রমা অনুষ্ঠিত হতো। সেই সংবাদে ভাষণের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। ওই সময় কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেখানে প্রচার করা সংবাদগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা জাহাজগুলো মেসেজ হিসাবে রিসিভ করত।’

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের বিপরীতে দোতলা একটি ভবনে অবস্থিত কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৬ একর জমিজুড়ে এই বেতারকেন্দ্রের স্থাপনা ছিল। পরে ২০০৩ সালে স্বাধীনতা পার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬ দশমিক ৩৭ একর জমি কমিয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে ৯ দশমিক ৩৭ একর জমির ওপর কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের টাওয়ার ও ভবন রয়েছে। বেতারের মূল অনুষ্ঠান আগ্রাবাদে রেকর্ড করার পর কালুরঘাট কেন্দ্রের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে দেশের মানুষকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিশেষ উদ্দীপনা জুগিয়েছিল কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র। বিপর্যস্ত জনপদের মানুষকে নানাভাবে সাহস জুগিয়ে, তথ্যসেবা দিয়ে ও নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দিয়ে জাতীয় জীবনে অসামান্য অবদান রেখেছিল এটি। তবে দীর্ঘ ৫৪ বছরেও চট্টগ্রামের এই ঐতিহাসিক বেতারকেন্দ্রের দৈন্যদশা ঘোচেনি। যেভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শুরু হয়েছিল কেন্দ্রটির পথচলা, তা এখনো সেভাবেই চলছে। নাজুক সম্প্রচারযন্ত্র, প্রকৌশলীর ঘাটতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট লেগেই আছে।

সরেজমিন দেখা যায়, নিচতলায় নামাজের ঘরের বিপরীতে লাল কার্পেট বিছানো ‘১১১’ নম্বর কক্ষের বাইরে লাগানো ফলকে লেখা রয়েছে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা কক্ষ (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র), বাংলাদেশ বেতার, চট্টগ্রাম।’ এর পাশের কক্ষেই আছে বেতারকেন্দ্রের বর্তমান ১০০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষণায় ব্যবহৃত মাইক্রোফোন, টেবিল, চেয়ার, রেডিও কনসোল, মূল ট্রান্সমিটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কালুরঘাট থেকে সরিয়ে ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’-এ নিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠরত জিয়াউর রহমানের একটি প্রতিকৃতিও রয়েছে।

কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের আবাসিক প্রকৌশলী ভাস্কর দেওয়ান বলেন, ‘যে কক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন্মের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সেই কক্ষটি সংরক্ষিত রয়েছে। গত তিন বছর আগে কিছু সংস্কারের কাজ হয়েছে।’

ঊষার আলো-এসএ