UsharAlo logo
রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

১০ আসামির জবানবন্দিতে উঠে এল রাসেল হত্যার বর্ণনা

usharalodesk
এপ্রিল ২৩, ২০২৪ ৮:৩২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : নিজেদের দলের সদস্য সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেলকে হত্যার ঘটনায় নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন ‘আব্বা বাহিনী’র অন্তত ৩০ জন সদস্য। তাঁদের মধ্যে আটজন তাঁকে বেশি মারধর করেন।

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা রাসেল হত্যা মামলায় ১০ আসামির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এই তথ্য। আব্বা বাহিনীর মাঠের নেতা ও অন্যতম নিয়ন্ত্রক আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বিও আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে ঘটনায় কারা কারা জড়িত, তা জানিয়েছেন।

আসামিরা জবানবন্দিতে বলেছেন, আফতাব উদ্দিনের নির্দেশে তাঁরা রাসেলকে ধরে নিয়ে যান। তারপর নির্যাতন চালান। কারণ ছিল টাকার ভাগাভাগি। রাসেল ব্যবসায়ী, মাদক বিক্রেতাসহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে তা আত্মসাৎ করেছিলেন।

পুলিশ ও আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মো. সজীব নামে এক আসামি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, আফতাব উদ্দিন চাঁদা ওঠাতেন রাসেলকে দিয়ে। নির্বাচনের আগে (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ) চাঁদা উঠিয়ে পুরো টাকা আফতাবকে দেননি রাসেল। এ কারণে রাসেলকে মারতে মারতে নিয়ে আসতে বলেন আফতাব।

জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, রাসেলকে নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন দেলোয়ার, ‘ভাতিজা’ রনি, শিপন, ‘দুর্বল’ সুমন, ‘দ্বারাজ’ সুমন, রিপন, আরমান, রুবেল, বাপ্পি-১, বাপ্পী-২, মিলন, রব্বানী, রানা, শফিক, শ্যামল, রাশেদ, বান্না, সোহেল, মাইকেল, জুম্মন, রতন, হিরন, বাবু, সনি, রনি, অপু, রাজীব আহমেদ, শরীফ, সজীবসহ আরও অনেকে। বেশি মারধর করেছেন বাপ্পী, রানা, রুবেল, মিলন, হিরন, অপু, শরীফ ও রাজু।

বুড়িগঙ্গার ওপারে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের আব্বা বাহিনী গত ৯ জানুয়ারি রাসেলকে নির্যাতন কেন্দ্রে (টর্চার সেল) মারধর করে। পরদিন তিনি মারা যান। সেই নির্যাতনের ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ‘আব্বা বাহিনী’ আলোচনায় আসে।

রাসেল হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা তোফাজ্জল হাওলাদার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় আফতাব উদ্দিনসহ ১৩ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। পরে পুলিশ আফতাবসহ আব্বা বাহিনীর ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।

এদিকে আফতাব গত ২১ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। গত রোববার আফতাবের জামিন স্থগিত করে তাঁকে সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। অবশ্য কেরানীগঞ্জের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আফতাব এলাকা ছেড়েছেন।

নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, আফতাব উদ্দিনের নির্যাতন কেন্দ্রে রাসেল অর্ধমৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁর গা খালি। বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। দুই পাশে চেয়ারে বসে রয়েছেন আব্বা বাহিনীর অন্তত ১৩ সদস্য। সামনে একটি টেবিল ও চেয়ার। চেয়ারে বসা আফতাব।

আফতাব উদ্দিন আদালতে তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি ও তাঁর চাচা শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের নাম করে রাসেল ব্যবসায়ী ও মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন। তবে রাসেল চাঁদার টাকা আফতাবকে দিতেন না। বিষয়টি জেনে রাসেলকে নিজের কার্যালয়ে ডেকে আনতে বলেন তিনি।

আফতাব আরও বলেছেন, রাসেলকে ধরে নিয়ে আসার পর তিনি শুধু একটি থাপ্পড় মারেন। অন্যরা তাঁকে মারধর করেছেন।

অবশ্য দেলোয়ার, রাজীব আহমেদ ও অনীক হাসান নামের তিন আসামির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, আফতাবের সামনেই রাসেলকে নির্যাতন করা হয়। মারধরের একপর্যায়ে রাসেল আফতাবকে ‘আব্বা আব্বা’ বলে তাঁকে বাঁচাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু রক্ষা করেননি আফতাব।

রাসেলকে যে যাঁর মতো মারধর করেছেন উল্লেখ করে আরেক আসামি আমির হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, আফতাব উদ্দিনের হুকুমে রাসেলকে সবাই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি, লাথি, চড় ও থাপ্পড় মারতে থাকেন। সেখানে যাঁরা ছিলেন, যে যেভাবে পারেন, সেভাবে রাসেলকে মারধর করেছেন।

রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে মারধর শুরু হয় জানিয়ে আলমগীর হোসেন নামের এক আসামি তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, রাত ১২টার দিকে আফতাব উদ্দিন নিহত রাসেলের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারকে ডেকে আনেন। তখন রাসেল অজ্ঞান। রাসেলের স্ত্রীকে আফতাব বলেছিলেন, ‘তোমার স্বামী আমার নাম করে টাকা তুলেছে। ২০ লাখ টাকা দিতে হবে।’

ঘটনার পর স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছিল, ৯ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সহযোগীদের দিয়ে রাসেলকে তাঁর বাসায় অর্ধমৃত অবস্থায় পাঠিয়ে দেন আফতাব উদ্দিন। পরদিন তিনি মারা যান। তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, আব্বা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর স্বামীকে হাসপাতালে নিতে দেননি।

আফতাব উদ্দিন তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি ব্যবসা ও রাজনীতি করেন। তিনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (গ্রেপ্তারের পর বহিষ্কৃত)। তাঁর বাবা বাছের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর চাচা ইকবাল হোসেন শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আরেক চাচা সাকুর হোসেন জিনজিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। নানা কারণে তাঁরা এলাকায় প্রভাবশালী।

জবানবন্দিতে অন্তত ৩০ জনের নাম এলেও সবাইকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। কেউ কেউ এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আব্বা বাহিনীর বিরোধীদের হুমকি দিচ্ছেন।

রাসেল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক আবুল হাসান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আসামি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন তথ্য তিনি জানেন না। তাঁর দাবি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, তদন্তে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

অবশ্য রাসেলের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারের অভিযোগ, যাঁরা হত্যায় জড়িত, পুলিশ তাঁদের ধরছে না। যাঁরা জড়িত নন, এমন অনেক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। তিনি বলেন, মামলার প্রধান আসামি আফতাব উদ্দিন এরই মধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, খুনের বিচার পাওয়া নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মৌসুমী আক্তার আরও বলেন, আফতাব উদ্দিন জামিনে বেরিয়ে বিভিন্ন লোকজন দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এমনও বলা হচ্ছে, মামলা তুলে না নিলে রাসেলের মতো পরিণতি হবে।

ঊষার আলো-এসএ