ঊষার আলো রিপোর্ট : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এনামুল হকের বিরুদ্ধে সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রভাব পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে। বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক বলছেন, ব্যক্তিগত আক্রোস থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয়েছে।
এর আগে ২৩ মে অধ্যাপক এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। তবে এ বিষয়টি কেন্দ্র করে বিভাগের শিক্ষকদের দুই পক্ষ উপাচার্য বরাবর পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন। অধ্যাপক এনামুল হকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায় একটি পক্ষ।
তবে সভাপতি কেয়ার বিরুদ্ধে বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক স্বাক্ষরিত উপাচার্যের কাছে লিখিত পাল্টা অভিযোগ দেন। সেখানে তারা বলেছেন, সভাপতি কেয়ার অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ঘটনা সত্য নয়। সেটি অ্যাকাডেমিক মিটিং তর্কবিতর্ক হয়েছে। সেটি বিভাগের বিষয় বিভাগেই আলোচনা হতে পারত। বিভাগের স্বার্থে তারা উপাচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এদিকে বিভাগের সভাপতি কেয়া অভিযোগে বলেন, ‘গত ২১ মে দুপুরে বিভাগের সভাপতির অফিসকক্ষে অন্য শিক্ষকদের সামনেই অধ্যাপক এনামুল হক সহকর্মী নারী শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে অশোভন ও অশালীন আচরণ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির সভা হয়। এ সময় তাকে ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হলে তিনি আবারও অশোভন আচরণ করেন এবং অশালীন ও অকথ্য ভাষায় যা করার করতে বলেন। বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তিনি তার এ আচরণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানান।
একই দিন ৯ শিক্ষক বিভাগের সভাপতির অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ঘটনার বর্ণনা করে অধ্যাপক এনামুল হকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
তবে সভাপতি কেয়ার অভিযোগে উল্লিখিত ঘটনায় পুরোপুরি সত্য না হওয়ায় ৯ শিক্ষকের মধ্যে তিন শিক্ষক অভিযোগপত্র থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন। অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর প্রত্যাহার করে এই তিন শিক্ষক উপাচার্য বরাবর একটি চিঠিও দিয়েছেন।
স্বাক্ষর প্রত্যাহারকারী শিক্ষক ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশিক শাহরিয়ার বলেন, ২৩ মে আমি অ্যাকাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে ছিলাম না। পরে সভাপতি ম্যাম ঘটনাটি জানলে আমি ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করি। তবে বিভাগের অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ঘটনাটি যেভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তেমনটি ঘটেনি। তাই আমি অভিযোগ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছি। একই সঙ্গে আমরা কয়েকজন শিক্ষক বিষয়টি সমাধানে উপাচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেছি।
এদিকে অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ঘটনা সত্য নয় দাবি করে গত ২৪ মে বুধবার বিভাগের আটজন শিক্ষক উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে ওই শিক্ষকরা উল্লেখ করেছেন, অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ঘটনাটি সত্য নয়। তবে বিভাগের অভ্যন্তরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বিভাগের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বিভাগেই নিরসন হওয়া উচিত। এটা বিভাগের পঠন-পাঠনের পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে তারা উপাচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তরুণ কুমার জোয়ারদার বলেন, গত ২৩ মে বিভাগের একাডেমিক মিটিং ছিল। ওই মিটিংয়ে একটি বিষয় মতবিরোধ তৈরি হয়। একপর্যায়ে তর্কবির্তক শুরু হয়। পরে বিভাগ সভাপতি মিটিংটি সমাপ্ত করে দেন। মিটিং শেষ হলেও আবারও ওই বিষয়টি নিয়ে তর্কবির্তকের একপর্যায়ে ওই দুই শিক্ষকের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে আমরা কয়েকজন সহকর্মী তাদের নিবৃত্ত করতে দুজনকে দুইপাশে নিয়ে যাই। এই হলো মূল ঘটনা। তবে অভিযোগপত্রে যেসব ব্যাপার উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো দেখে আমরা অবাক ও লজ্জিত হয়েছি। ওই দিন এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, তর্কবিতর্কের সময়ে উচ্চবাচ্য বাক্যবিনিময় হবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সময়ের উচ্চবাক্যকে নিয়ে কেউ ব্যক্তিগত আক্রোসে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে। মূলত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের অভিযোগ, যা খুবই দুঃখজনক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ভুক্তভোগী অধ্যাপক নাজমা আফরোজ বলেন, আমরা ১৫ বিভাগীয় শিক্ষক ওই সময়কক্ষে উপস্থিত ছিলাম। সবার সামনে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে অশালীন কথাবার্তা বলেন। এ ঘটনার পরে মঙ্গলবার একাডেমিক কমিটির সভাশেষে সভাপতি বিভাগের সব শিক্ষককে বসতে বলেন। পরে ড. এনামুল হককে সেদিনের আচরণ ভবিষ্যতের না করার জন্য সতর্ক করা হলে আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ড. এনামুল হক।
তিন শিক্ষকের স্বাক্ষরের প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে তিনজন শিক্ষক অভিযোগ প্রত্যাহার করেছে তারাও সে রকম মনমানসিকতা বহন করে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক এনামুল হক কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভাগীয় সমিতির কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছে অনেক আগে। এতদিন পর বিভাগের সভাপতি কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য এক ঘণ্টা আগে জরুরি মিটিং ডাকেন। কিন্তু আমি ২৪ ঘণ্টা আগে নোটিশ দিতে হয় এমনটি বলি। যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। কিন্তু তিনি লিখিত কোনো নোটিশ না দিয়েই মৌখিকভাবে সেটি জানান।
এটাতে আমি বাধা দিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে ফোন দেন এবং অনুমতি নেন। পরে আমি রেজিস্ট্রারকে বলি আমাদের কয়েকজন শিক্ষক অনুপস্থিত আছেন এক ঘণ্টা আগে মৌখিকভাবে বলে তো অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনৈতিক হয়ে যায়। তখন তিনি নিষেধ করলেন। এসব কথাবার্তা শেষ হলে সভাপতি আমাকে বলে নিজে কত অনৈতিক কাজ করে বেড়াই আর এ মিটিংটা হতে দিল না। আমি বলি এটা তো আমার কথা না, অধ্যাদেশ অনুযায়ী হয় না। পরে এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘হয়তো ওই সময় ইমোশনালি সে আমাকে বলেছে— আমিও তাকে বলেছি যে, অনেকেই তো অনেক কিছু করে থাকে। আপনি যেমন আমার কীর্তি ওপেন করে দিচ্ছেন আমিও কিন্তু সবার কীর্তি ওপেন করে দেব। এটুকুই হয়েছে আর কিছু না। এই জিনিসটাকেই যৌন হয়রানি হিসেবে অভিযোগ করেছেন।’
ড. এনামুল আরও বলেন, ‘এর পর আরেকটি জরুরি মিটিং শেষে ইন্টেনশনালি সভাপতি আমাকে বলেন, আপনি যে আচরণগুলো করছেন, এগুলো কখনই কাম্য নয়। আমি বলি, আমি একজন অধ্যাপক আপনি এভাবে আমাকে বলতে পারেন না। একাডেমিক কমিটি ডাকেন আমাকে বলেন। এ সময় আমি খোয়াল করিনি যে তিনি আমার কথাবার্তা গোপনে ভিডিও করছিলেন। এ ভিডিওটিকেই পরবর্তী পর্যায়ে কাজে লাগাচ্ছেন।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি বিভাগের সভাপতি হওয়ার পর বিভাগের প্রথম অ্যালামনাই অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিই। সেখান দুটি ক্যাটাগরিতে দুজনকে সম্মাননা দেওয়া হয়। একটা হলো— মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে আহত একজনকে ও প্রথম যিনি ছাত্র ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা তাকে দেওয়া হয়। আমাদের বর্তমান সভাপতি কেয়া ম্যামের বাবা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একজন। তাকে কেন দেওয়া হলো না, এইটা তুলে তিনি তখন বলেছে, সভাপতি রাজাকার, আলবদর, জামায়াতে ইসলামী এ জন্য আমার বাবাকে দেয়নি। প্রবাবলি ওই জায়গা থেকেই তিনি আমার ওপর ক্ষুব্ধ। এমনকি কেয়া ম্যাম সভাপতি হওয়ার পর পরই আমাকে ভয়ও দেখিয়েছেন যে, এনামুলের চাকরি আমি এক মিনিটে শেষ করে দিতে পারি।
তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাচার্য মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং এর সুষ্ঠু সমাধান কামনা করছি। কেননা শিক্ষকদের মনোমালিন্যের এ বিষয়টি দ্রুত সমাধান না হলে ছাত্রছাত্রীসহ বিভাগের সামগ্রিক একাডেমিক কর্মকাণ্ডের ওপর এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, যে কেউ অভিযোগ করতে পারে। অভিযোগ করলেই ঘটনা সত্য হবে এমনটি নয়। দুপক্ষের অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ ইতোমধ্যে লিগ্যাল সেলে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে যৌন হয়রানির সেলে যাবে। পরে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঊষার আলো-এসএ