ঊষার আলো রিপোর্ট: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু (৩৫) রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একজন কর্মকর্তা। ২০১৭ সালে জুনিয়র সেকশন অফিসার হিসাবে রুয়েটে যোগদান করেন তিনি।
কিছুদিন অনিয়মিত অফিস করলেও ২০১৮ সালের জুনের পর আর একদিনও রুয়েটে তার কর্মস্থলে যাননি। যদিও গত পাঁচ বছর তিনি রুয়েট থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাসহ সব আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। পেয়েছেন এসিআর ও ইনক্রিমেন্টও।
এই পাঁচ বছর ধরে টিটু রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) হিসাবে কাজ করছেন। নগর ভবনে নিয়মিত অফিস করে এখানেও তিনি ভোগ করেছেন সরকারি সুযোগ-সুবিধা।
সম্প্রতি রুয়েটে নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম যোগদানের পর বিষয়টি তার গোচরে আসে। ফলে রুয়েটের রেজিস্ট্রার ৭ সেপ্টেম্বর টিটুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। তাকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির বিষয়ে সাত দিনের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যদিও টিটুর দাবি, তিনি সিটি মেয়রের সুপারিশে ডেপুটেশন বা প্রেষণে কাজ করেছেন। কিন্তু প্রেষণ বা ছুটিসংক্রান্ত কোনো নথিপত্র রুয়েটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। নগর ভবনেও এ সংক্রান্ত কোনো দাপ্তরিক নথিপত্র নেই। জানা যায়, টিটু রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন।
পরে ২০১৩ সালে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্মসম্পাদক হন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই আরও অনেকের সঙ্গে টিটু রুয়েটে চাকরি পান। ওই বছরের ২৭ জুলাই তাকে জুনিয়র সেকশন অফিসার হিসাবে পুরকৌশল বিভাগে পদায়ন করা হয়।
এদিকে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই রাসিক নির্বাচনে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচিত হলে টিটু তার পিএ হিসাবে কাজ শুরু করেন। রুয়েটের নথিপত্রে দেখা যায়, পাঁচ বছরে টিটু একদিনের জন্যও রুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে তার কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।
বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ সাজ্জাদ ৪ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রার দপ্তরকে লিখিতভাবে জানান, তিনি ২০২২ সালের ২ অক্টোবর বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর জুনিয়র সেকশন অফিসার টিটুকে একদিনের জন্যও অফিসে পাননি। বিভাগের আগের সভাপতিরাও একই তথ্য দিয়েছেন।
রুয়েটের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জুনিয়র সেকশন অফিসার হিসাবে টিটু রুয়েটে যোগদানের পর রূপালী ব্যাংক রুয়েট করপোরেট শাখায় ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই ৩৭২৩০১০০১৩৪৪০ নম্বরের একটি সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাব চালু করেন। ওই হিসাব নম্বরে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত বেতন-ভাতা জমা হয়েছে। টিটুর মাসিক বেতন ৩০ হাজার ৫৩ টাকা ৫০ পয়সা নিয়মিতভাবে ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে এবং তা তিনি উত্তোলন করেছেন।
চাকরিস্থলে অনুপস্থিত থেকেও গত পাঁচ বছরে তিনি মোট ১৯ লাখ ৩ হাজার ১৮০ টাকা বেতনভাতা নিয়েছেন রুয়েট থেকে।
এ বিষয়ে রুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আরিফ আহমেদ চৌধুরী শনিবার দুপুরে বলেন, টিটু দীর্ঘদিন তার চাকরিস্থল রুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে অনুপস্থিত আছেন কোনো নোটিশ ছাড়াই। এ কারণে ৭ সেপ্টেম্বর তাকে সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। টিটু শোকজ লেটার পেয়েছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। জবাব আসার পর বিধি অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা যায়, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও ২০১৯ সালে পুরকৌশল বিভাগের ওই সময়ের সভাপতি অধ্যাপক কামরুজ্জামান টিটুকে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন বা এসিআর দিয়েছেন। তবে তার আগের সভাপতি অধ্যাপক নিয়ামুল বারী তাকে এসিআর দিতে অস্বীকার করেন। ফলে মেয়াদ পূর্তির দেড় বছর আগেই অধ্যাপক বারীকে পুরকৌশল বিভাগের সভাপতির পদ ছাড়তে হয়। বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ সাজ্জাদ বহু চাপাচাপির পরও টিটুকে আর এসিআর দেননি।
রুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ সাজ্জাদ বলেন, আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু কোথায় কী করেন জানি না। তবে আমি বিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পর একদিনও তাকে অফিসে পাইনি। কোন প্রক্রিয়ায় তিনি রুয়েটের বাইরে কাজ করছেন, তা আমার জানা নেই।
অভিযোগ সম্পর্কে আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন থেকে চাহিদাপত্র রুয়েটে পাঠানোর পর আমাকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র রুয়েট ও রাসিকে নেই কেন-জানতে চাইলে টিটু দাবি করেন, ডেপুটেশনের কাগজপত্র আছে।
নথিপত্র দেখাতে পারবেন কি না-প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুঁজে দেখতে হবে। এখন কাছে নেই। তবে টিটুর ডেপুটেশনের কোনো আবেদন অথবা সুপারিশপত্র রুয়েটে আসেনি। এমন আবেদন বা সুপারিশ থাকলে রুয়েটের নথিপত্রে এবং টিটুর ব্যক্তিগত চাকরি ফাইলে জমা থাকত। একই দাবি করেন পুরকৌশল বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ সাজ্জাদ। তিনি বলেন, টিটুর ডেপুটেশন সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র বিভাগের নথিপত্রে নেই।
রাসিক মেয়রের পিএ হিসাবে কর্মরত থাকলেও বিষয়টি ডেপুটেশনের মাধ্যমে নয় বলে মতামত দিয়েছেন রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্মসচিব) ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন। তিনি বলেন, এটি মেয়র সাহেবের ব্যক্তিগত বিষয়। রাসিকে টিটুর কাজের সঙ্গে অফিসের কোনো সম্পর্ক নেই। আর তিনি ডেপুটেশনে আছেন বলেও আমার জানা নেই। এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাজ করার বিষয়টি একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ার বিষয়। রাসিকে তার সম্পর্কে কোনো নথিপত্র নেই।
তবে রাসিকের ২০২৩ সালের নতুন ডায়েরিতে টিটুর নাম রয়েছে। তাতে তার পদবি লেখা হয়েছে মেয়রের পিএ।
এ বিষয়ে রুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কেউ কোনো অনিয়ম করে থাকলে এবং এই অনিয়মে কেউ প্রশ্রয় দিয়ে থাকলে তার ফলাফল ও দায় তাদেরই নিতে হবে। যারা রাষ্ট্রের ক্ষতি করবেন, যারা অনিয়মে জড়াবেন, তারা কেউ ছাড় পাবেন না।
ঊষার আলো-এসএ