নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তার সরকারের মেয়াদ ছয় মাস অতিক্রম করছে। আর এ সময়কার আমলনামা বিশ্লেষণ নিয়ে এখন কতকিছুই না হচ্ছে। দোষত্রুটি খুঁজে বের করতে অনেকের হয়তো বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকুও নেই। তবে আমার মত একটু ভিন্ন। আমি চাই, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্মোহ বিশ্লেষণে ভালোমন্দের সবটুকু বেরিয়ে আসুক। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী দেশি-বিদেশি যেসব চক্র সারাক্ষণ এ সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে। তা না হলে বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন এবং প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের দেখা শেষ পর্যন্ত মিলবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়-সন্দেহ এখনো বিরাজমান।
গণবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঐতিহাসিক দিন ৫ আগস্ট। মাঝখানে বিপ্লবী জনতার জনস্রোতে টালমাটাল আরও দুদিন পার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই সময় প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্রনায়করা সরকারের শীর্ষপদে তাকেই চেয়েছিলেন। তিনিও একপর্যায়ে সম্মত হন। আর হাসিনার দুঃশাসনে নির্যাতিত-নিপীড়িত দেশের কোটি কোটি মানুষও তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যার যাওয়ার কথা ছিল জেলখানায়, তিনি এলেন বঙ্গভবনে। শপথ নিলেন প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে। দিনটি ছিল ৮ আগস্ট। ইতিহাসের পাতায় এটিও একটি মাইলফলক হিসাবে জায়গা করে নেয়।
ড. ইউনূসের সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন বিপুল প্রত্যাশার মধ্যে মোটা দাগে কয়েকটি দাবি ছিল খুবই যৌক্তিক ও প্রণিধানযোগ্য। সেগুলো হলো-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য দ্রুত নিয়ন্ত্রণ আনা; গণ-অভ্যুত্থানে যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের খুনিদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা; যারা আহত হয়েছেন, তাদের উন্নত চিকিৎসাসহ পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া এবং ফ্যাসিস্ট হিসাবে চিহ্নিত আওয়ামী লীগে থাকা সব ধরনের অপরাধীর গ্রেফতার নিশ্চিত করে বিচারের মুখোমুখি করা। যদি ভুল করে না থাকি, এটিই ছিল সর্বসাধারণের চাহিদা বা প্রত্যাশার প্রথম তালিকা। এখন এ বিষয়ে ইউনূস সরকারের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতেই পারে। অবশ্য ইতোমধ্যে নানাভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলনামা নিয়ে পোস্টমর্টেমও শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আজকের এদিনে তো আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।
এখন আসা যাক মূল কথায়। ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আমরা কী দেখলাম। ব্যাংকগুলো খালি, টাকা নেই। লুটপাট করে সব সাবাড় করে দিয়ে গেছে শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা। মাথার ওপর দেশি-বিদেশি বড় বড় ঋণের কিস্তি পরিশোধের বোঝা। মোট কথা, দেশের আর্থিক অবস্থা তখন ১২টা বেজে ১৩টার কাঁটায় ঝুলছে। বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে জনরোষে এমনিতেই হাসিনার জন্য পতন অপেক্ষা করছিল। ঠিক সেরকম একটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দায়িত্ব নিতে হয় ইউনূস সরকারকে। উপরন্তু দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ভয়াবহ বন্যা। বিনা নোটিশে ভারত ত্রিপুরার ডুমুর বাঁধ খুলে দেয়। স্রোতের মতো পানি ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলার। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। যদিও সেসময় সরকারের পাশাপাশি বেশকিছু সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠনসহ সাধারণ মানুষও বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
অথচ এরকম একটি অবস্থায় আমাদের খুবই হতবাক হয়ে দেখতে হলো-নানা ছদ্মাবরণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসররা দাবিদাওয়া আদায়ের নামে মাঠে নামছে। একের পর এক দাবির মিছিল। আর এসব দাবি আদায়ের মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন দেখে মানুষ ভাবতে লাগল, আহারে! এরা বুঝি আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে কত না নির্যাতন ও কষ্ট সহ্য করেছে। সবাই এক নিমেষে ভুলে গেল হাসিনা সরকারের আমলের কোটি কোটি আওয়ামী দলদাসদের কথা। প্রশাসনসহ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মধ্যে সর্বত্র তো আওয়ামী লীগের ছড়াছড়ি অবস্থা, জয়জয়কার ছিল। তাহলে প্রশ্ন হলো-এত বিপুলসংখ্যক আওয়ামীভক্তরা গেল কোথায়।
বাস্তবতা হলো, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে পেরেছে বড়জোর এক শতাংশ। বাকিরা দেশের মধ্যেই আছে। ওইসব আফসোস লীগরা এখন নানা নামে দাবি আদায়ের কথা বলে সরকার উৎখাতের গভীর ষড়যন্ত্র করছে। এটিই হলো সারকথা এবং অতি বাস্তব চিত্র।
শুরুটা হয়েছিল সচিবালয়ের সামনে আনসারদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি দিয়ে। আসলে তারা যে ‘আনসার লীগ’ ছিল, তা দিনকয়েকের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের নামে চলতে থাকল লাগাতারভাবে গার্মেন্টে আগুন দেওয়া ও ভাঙচুরের ঘটনা। এর মধ্যে আবার পরীক্ষা না দিয়ে অটোপাশের দাবিতে শত শত শিক্ষার্থী ঢুকে পড়ল সচিবালয়ে। অবশ্য এর পেছনে থাকা আওয়ামী খলনায়কদের আবিষ্কার করতে সরকারের বেশি সময় লাগেনি। ওই সময় দাবি আদায়ের বেশকিছু অপতৎপরতা একসঙ্গে ঘটতে থাকে। কথিত রিকশা লীগ, ব্যাটারি লীগ, ইসকন লীগসহ কেউ বাদ যায়নি। শিক্ষক ও ডাক্তারের একটা অংশও তখন মাঠ সরগরম করতে থাকে। ওদিকে শুরু হয়ে গেল পাহাড়ে গোলাগুলি। যাতে বাঙালি আর পাহাড়িদের মধ্যে একটা বড় ধরনের দাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়া যায়। আবার সীমান্তে হত্যা আর উসকানিও বাড়তে থাকল সমানতালে।
সবচেয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয় ইসকন নেতা চিন্ময় কৃঞ্চ দাসকে গ্রেফতার করার পর। ওই সময় দেশি-বিদেশি চক্র দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে রীতিমতো আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। যার বিষাক্ত মাত্রা ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা। এ চ্যানেলের সাংবাদিক ময়ুখরঞ্জন ঘোষ যা শুরু করলেন, তা কোনোভাবে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। মিথ্যা আর গুজবে ভর করে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হিংসাবিদ্বেষ উগরে দিতে থাকলেন অনেকটা পাগলের মতো। কী যেন হারিয়ে গেছে তার। সেই ‘হারানো মানিককে’ ঘিরে এই গুজবযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হলেন তার মতো আরও কিছু বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম ব্যক্তি। যারা শুধু মিথ্যা আর গুজব ছড়িয়ে ক্ষান্ত হননি, কখনো চট্টগ্রাম আবার কখনো ফেনীকে আলাদা করে ফেলেন বাংলাদেশ থেকে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে কী বীভৎস ছিল সেসব আগ্রাসী বয়ান। আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে তারা একটি নেরেটিভ তৈরি করে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে তৎপর ছিলেন। ছিলেন বললে ভুল বলা হবে, এখনো আছেন। অভিযোগ আছে-এসব অপপ্রচারের পেছনে ফ্যাসিস্টদের বড় অঙ্কের ফান্ড বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আর যারা এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে থাকেন, তারা সবসময় সক্রিয়।
ওইসময় রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে-৪৯টি ভারতীয় গণমাধ্যম ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর ১৩টি মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ বা সম্প্রচার করে। রীতিমতো গুজব ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের ‘বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী’ ভারতের কিছু গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি একটি চক্র ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে দফায় দফায় অপচেষ্টা করে গেছে এবং এখনো অব্যাহত আছে।
এর মধ্যে মাত্র কয়েকদিন আগে ধর্মঘটের কর্মসূচি দেয় রেল কর্মচারীদের সংগঠন। এরও কয়েকদিন আগে তিতুমীর কলেজসহ সাত কলেজের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। আমরা তাদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করছি না। তবে আন্দোলনের ধরন ও গতিবিধি বিশ্লেষণ করলে অনেক সূত্রের দেখা পাওয়াটা কঠিন কিছু হবে না। এছাড়া সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের কথাও কিন্তু কেউ ভুলে যায়নি। টেকনিক্যাল কমিটি যে রিপোর্ট দিক না কেন-সচেতন মানুষ কিন্তু সঠিক হিসাবটা করেছে।
দৃশ্যত এখনো আমরা কী দেখছি। সব ষড়যন্ত্র কি থেমে গেছে? উত্তর-না, থামেনি। বরং বলব বেড়েছে এবং আরও বাড়বে বৈকি। হয়তো ধরনটা ভিন্ন। ভিন্ন মোড়কে, ভিন্ন লেবাসে সরকারের ভেতর ও বাইরে ঢুকে পড়ছে ষড়যন্ত্রের বিষকাঁটা। আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার, সেটি হলো-চেনা শত্রু মোকাবিলা করা যতটা সহজ, অচেনা শত্রু মোকাবিলা করা ততটাই কঠিন। আবার কবির ভাষায়, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ যদিও আমরা এরকম কোনো দুঃস্বপ্নের কথা ভেবে নৈরাশ্যবাদী হতে চাই না। আমরা আশাবাদী। কারণ, আশা আর স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যদিও আওয়ামী লীগের প্রথমসারির গডফাদাররা কীভাবে পালিয়ে যেতে পারল-সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। নিশ্চয় একদিন তাদের সহায়তাকারীদের কেউ না কেউ খুঁজবেই।
শেষ কথা, এখন আমরা কী চাই? সমস্বরে সবাই নিশ্চয় বলবেন-সুন্দর একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। যেখানে সত্যিকারার্থে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার থাকবে। বীরত্বের সঙ্গে দেশ ও দেশের মানুষ উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে যাত্রা করবে। ক্ষমতায় আসা কিংবা টিকে থাকার জন্য কোনো দেশ বা গোষ্ঠীর গোলামি বা দাসত্ব করবে না। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে, চোখে চোখ রেখে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারবে গণমাধ্যমকর্মীরাও। ফ্যাসিস্ট, খুনি ও লুটেরাদের সবার বিচার নিশ্চিত হবে। দেশ দ্রুত নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবে। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মানুষরা মনোনয়ন পাবে। দেশ ভবিষ্যতে আর নতুন কোনো ফ্যাসিস্ট, পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি থাকবে না। সর্বত্র মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
এসব যদি আমাদের প্রত্যাশা হয়, তাহলে ড. ইউনূস সরকারের দোষ খুঁজে লাভ নেই। এটি তো ওয়ান-ইলেভেন সরকার নয়। ফলে সবার উচিত হবে, গণ-অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া। এ সরকারের অনেক ভুলত্রুটি থাকবে। কিন্তু সেটিকে ইস্যু বানানো যাবে না। ভুল থাকলে শুধরানোর চেষ্টা করতে হবে এবং সবাই মিলে প্রতিহত করতে হবে সংকট ও ছদ্মবেশী ষড়যন্ত্রকারীদের।
ঊষার আলো-এসএ