রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ী হোসেন আলীর তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ২০ নভেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি দাবি করেন, গ্রেফতারের সময় তার গাড়ি থেকে তিনটি ব্যাংকের চেক বই নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই চেকের পাতায় স্বাক্ষর জাল করেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, ওই টাকা হাতিয়ে নিতেই গাড়িতে দেশি অস্ত্র ও মাদক রেখে তাকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল।
রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দা হোসেন আলী ৫ ফেব্রুয়ারি টাকা উত্তোলনকারী চক্রের বিরুদ্ধে আদালতে দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়েও অভিযোগ দিয়েছেন। এ মামলার আসামিরা হলেন হোসেন আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহমুদ হাসান শিশিল (৩৫), দুই কর্মচারী মাহমুদ হাসান লিমন (২৮), তন্ময় হোসেন (৩১), আরএমপির বোয়ালিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিরুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আওয়াল এবং ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. খালেকুজ্জামান ও আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক রবিউল হোসেন।
হোসেন আলীর আইনজীবী লিয়াকত আলী খান জানান, আদালতের বিচারক মামলাটি গ্রহণ করে তদন্তের জন্য রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) পাঠিয়েছেন। মামলার অভিযোগে জানা যায়, হোসেন আলী জমি, প্লট এবং পুরোনো গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। ১০ আগস্ট নগরীর রেলগেট এলাকায় যানবাহনে তল্লাশি করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। ওই সময় হোসেন আলীর গাড়ি তল্লাশি করা হলে ব্যাকডালায় কিছু দেশীয় অস্ত্র ও দুই বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়। তখন ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষার্থীরা তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করেন। পরদিন তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার মামলার এজাহারে হোসেন আলী বলেছেন, পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশিল এবং দুই কর্মচারী লিমন ও তন্ময় তার অগোচরে গাড়ির ব্যাকডালায় কয়েকটি দেশীয় অস্ত্র ও মাদক রেখে দেন। তারপর তারাই শিক্ষার্থীদের তথ্য দিয়ে গাড়িতে তল্লাশি করায়। ওই সময় তার গাড়িতে থাকা ব্যাগে ব্যাংকের চেক বইসহ অন্য জিনিসপত্রও ছিল। চেকগুলো নেওয়া হলেও সেগুলো জব্দ তালিকায় দেখানো হয়নি। সেই চেক দিয়েই জাল স্বাক্ষরে টাকা তোলা হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, তিনি কারাগারে থাকাকালে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ৯ লাখ, ১৮ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ, ২২ সেপ্টেম্বর ৯ লাখ এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ৪ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। চেকগুলোয় টাকা উত্তোলনকারীর নাম লেখা হয়েছে হাসান। ১৭ সেপ্টেম্বর হোসেনের হিসাবে ছিল ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৪৭৪ টাকা। চারটি চেকের মাধ্যমে ৩৩ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
এদিকে আইএফআইসি ব্যাংকে হোসেন আলীর রাজশাহী শাখার হিসাবে ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৬ টাকা। এর মধ্যে একটি চেকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তোলা হয় ৩ লাখ টাকা। আর ইউসিবিএল ব্যাংকের বানেশ্বর শাখার হিসাবে ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৪১৮ টাকা। ১ অক্টোবর চেকের মাধ্যমে এ ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে আইএফআইসির রাজশাহী শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল হোসেন ও ইউসিবিএলের বানেশ্বর শাখার ব্যবস্থাপক সুজন মোর্শেদ জানান, চেকের স্বাক্ষর তাদের কাছে হোসেনেরই মনে হয়েছে। তারপরও ব্যাংকে চেক আসার পর টাকা ছাড়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হোসেন আলীর মোবাইল ফোনে কল করা হয়েছিল। ফোনের ব্যক্তি নিজেকে হোসেন আলীই দাবি করেছিলেন। তাই তারা টাকা দিয়ে দেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়ে হোসেন আলী বলেন, ওই সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। তার ফোন জব্দ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি কীভাবে নিজের ফোন থেকে কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ইউসিবি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সুজন মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা তো কণ্ঠ পরীক্ষা করতে পারি না।’
অন্যদিকে আইএফআইসি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাহক হোসেন আলী আমাদের ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন। প্রধান কার্যালয় আমাকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। এজন্য কথা বলতে আমি হোসেন আলীকে ডেকেছি। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. খালেকুজ্জামান বলেন, আমরা বাহক চেক পেয়ে টাকা দিয়েছি। উনি অভিযোগ করেছেন। আমরা তদন্ত করে দেখছি।
হোসেন আলী দাবি করেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশিল ও দুই কর্মচারী তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসিয়েছেন। তারপর গাড়িতে থাকা চেক বই নিয়ে তারা দুই পুলিশ এবং ব্যাংকের কর্মকর্তার যোগসাজশে ৩৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
হোসেন আলী বলেন, ‘এ টাকা তারা ভাগবাঁটোয়ারা করেছেন বলে আমি জানতে পেরেছি। আমি এখন নিঃস্ব। আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। তারপরও আমার নামে রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে আসামি মাহমুদ হাসান লিমনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তন্ময় হোসেন কল না ধরে কেটে দেন। আর মাহমুদ হাসান শিশিল বলেন, ‘হোসেন আমার অধীনে ৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করত। সে এত টাকা পেল কীভাবে? আমি তার ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তুলিনি।’ ব্যাংক থেকে টাকা তোলায় যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেন পুলিশ পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম ও এসআই আবদুল আওয়াল। আমিরুল বলেন, ‘জব্দ তালিকা করেছিল অন্য একটি বাহিনী। তারা কি পেয়েছে না পেয়েছে, জানি না।’
এসআই আবদুল আওয়াল বলেন, ‘হোসেনের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়, সেটা আমি তদন্ত করছি। আমি চেকের বিষয়ে কিছু জানি না। কে টাকা তুলেছে, সেটাও বলতে পারব না।’
ঊষার আলো-এসএ