পাইকগাছা প্রতিনিধি : মিঠাপানির বিলুপ্তপ্রায় মাছ পূনরূদ্ধার ও সংরক্ষণের পর এবার উপক‚লীয় অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় চিত্রা মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের খুলনার পাইকগাছাস্থ লোনাপানি কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। চিত্রা মাছ উপকূলীয় অঞ্চলভেদে পায়রা, বিশতারা, বোথরাসহ একাধিক নামে পরিচিত। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Scatophagus argus। উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মাছের মধ্যে চিত্রা একটি। মাছটি দেখতে যেমন আকর্ষণীয় খেতেও তেমনি সুস্বাদু। এক সময় চিত্রা মাছ সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার নদ-নদী, খাড়ি ও ঘেরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। পরিবেশ বিপর্যয় ও সংরক্ষণের অভাবে এ মাছটি প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে (IUCN Bangladesh, 2000)। ইনস্টিটিউটের খুলনা জেলার পাইকগাছাস্থ লোনাপানি কেন্দ্রে মা মাছ প্রতিপালন করে চলতি বছরের মে-জুন মাসে কৃত্রিম প্রজননে এই সফলতা এসেছে। গবেষক দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন লোনাপানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং কেন্দ্র প্রধান ড. মোঃ লতিফুল ইসলাম।
কেন্দ্রের সূত্র জানায়, গবেষণার জন্য চার বছর আগে খুলনার শিবসা নদী এবং সুন্দরবন সংলগ্ন খাল হতে চিত্রা মাছের পোনা সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে, কেন্দ্রের আবদ্ধ পুকুরে প্রচলিত ভাসমান খাবারে অভ্যস্তকরণের মাধ্যমে প্রজননক্ষম মাছে পরিণত করা হয়। গবেষক দলের অন্যতম বিজ্ঞানী শাওন আহম্মেদ এই প্রতিবেদককে জানান, এই মাছ দৈর্ঘ্যে সাধারণত ৩৫ সে.মি. এবং সর্বোচ্চ ওজন ১.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। একই বয়সী পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছ অপেক্ষা আকারে ছোট হয়ে থাকে এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জীবদ্দশার ২য় বর্ষে কিছু মাছ প্রজননক্ষম হলেও ৩য় বর্ষে অধিকাংশ (৮০%) মাছ প্রজননক্ষম হয়। এসময় পুরুষ মাছের সর্বনি¤œ ওজন ৮০ গ্রাম এবং স্ত্রী মাছের ওজন ১৮০ গ্রাম হয়ে থাকে। একটি প্রজননক্ষম চিত্রা মাছ প্রতি গ্রাম দেহ ওজনের জন্য ২০০০-২৫০০টি ডিম ধারণ করে থাকে।
গবেষকদলের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ওয়াসীম জানান, চিত্রা মাছ স্বভাবে সর্বভুক এবং এর প্রজনন মৌসুম হচ্ছে এপ্রিল-জুলাই মাস। পরিপক্ক মাছকে হ্যাচারিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হরমোন প্রয়োগ করে প্রজননে উদ্দীপ্ত করা হয়। তিনি আরও জানান চলতি বছরের ফেব্রæয়ারী মাস থেকেই প্রজননের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু, এ বছর অতি খরাজনিত কারণে মাছের পরিপক্কতা আসতে বিলম্ব হলেও ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালানোর পর কাঙ্খিত সফলতা পাওয়া গেছে।
চিত্রা মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা প্রসঙ্গে গবেষক দলের প্রধান বিজ্ঞানী ড. মোঃ লতিফুল ইসলাম বলেন, গত চার বছর যাবৎ মাছটির কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে কেন্দ্রে গবেষণা করা হচ্ছে। প্রজননক্ষম মাছ উৎপাদন, প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ, প্রজননের জন্য উপযুক্ত লবণাক্ততা, উপযুক্ত হরমোন নির্বাচন ও ডোজসহ বিভিন্ন বিষয় নিরুপণের পরেই চিত্রা মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা এসেছে। তিনি আরও বলেন, হ্যাচারিতে এখন সর্বমোট পাঁচ (০৫) ব্যাচের পোনা রয়েছে। প্রথম ব্যাচের উৎপাদিত পোনার বয়স এখন ৩৪ দিন এবং সর্বশেষ ব্যাচের রেণুর বয়স ৫ দিন। উৎপাদিত রেণুগুলিকে প্রাথমিকভাবে গ্রীন এ্যালজি এবং রটিফার জাতীয় খাবার দিয়ে বড় করা হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে আর্টেমিয়া ও অন্যান্য রেডি ফিড প্রয়োগ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাদুপানির মাছের কৃত্রিম প্রজননের তুলনায় লোনাপানির মাছের কৃত্রিম প্রজনন কষ্টসাধ্য বিষয়। লোনাপানির মাছের প্রজননে পারিবেশিক ও পারিপাশির্^ক অনেকগুলো নিয়ামক বিবেচনায় নিতে হয় এবং রেণুর প্রাথমিক খাদ্য হিসাবে লাইভ ফিড প্রয়োজন হয় যা উৎপাদন কষ্টসাধ্য।
এ প্রসঙ্গে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, বিলুপ্তপ্রায় চিত্রা মাছের প্রজনন সফলতা ইনস্টিটিউটের জন্য গর্বের। আমাদের বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে এ সফলতা অর্জন করেছে। এক সময় চিত্রা মাছ প্রচুর পরিমানে পাওয়া গেলেও এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। চিত্রা মাছ সর্বভূক হওয়ায় উপকূলীয় ঘেরে অন্যান্য মাছের সাথেও চাষ করা যাবে। এছাড়া অ্যাকোরিয়ামে ব্যবহারের জন্য চিত্রা মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সুস্বাদু চিত্রা মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবিত হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে এর পোনা উৎপাদন, প্রাপ্যতা ও চাষের প্রসার ঘটবে। চিত্রা মাছের প্রজনন সাফল্য বাংলাদেশকে মেরিকালচার তথা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উল্লেখ্য, মিঠাপানির দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
(ঊষার আলো-আরএম)