UsharAlo logo
শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পানির স্তর নিচে নামায় সেচ সংকট ; লাখো নলকূপ অকেজো

usharalodesk
মার্চ ২২, ২০২১ ৩:৩৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো ডেস্ক : বৃষ্টির দেখা নাই, নদীতে পানি নেই, উন্মুক্ত জলাশয় ও পুকুরে পানি নেই। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির। অথচ এ সময়টায় ধানক্ষেতের পাশের নালা-ডোবা, হাওর-বিলের পানি দিয়েই বোরো ক্ষেতে সেচ দিতেন কৃষক। দেশে সেচের পানি সংকটের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টিপাত কম হওয়া। সেচের জন্য অপরিকল্পিতভাবে মাটির নিচের পানি উত্তোলন করায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় জানানো হয়, প্রতি বছর ভূ-গর্ভের পানির স্তর দুই থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে। এতে পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ যেমন বাড়ছে, ভূমিধস ও মাটি দেবে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চৈত্র মাস বোরো ধানে সেচের পিক সিজন। অব্যাহতভাবে পানির স্তর নিচে নামায় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে গত বোরো মৌসুমে সারাদেশের চার লাখেরও বেশি অগভীর নলকূপে পানি ওঠেনি। এ বছরও ৫৩ জেলার দুইশ’ ১৬ উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট সেচ মৌসুমে দেখা দিয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই সোয়া তিন লাখ নলকূপে পানি উঠছে না। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের দেড় লাখ নূলকপে পানি পাচ্ছেন না কৃষক। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রায় এক লাখ অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ। বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের হিসাবে আগামী ১০ বছরে ব্যয় তিনগুণ বাড়বে। কৃষি উৎপাদনের ৬২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সেচে। সংস্থাটির গত বছরের ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক দশক আগেও প্রতি হেক্টরে বোরো আবাদে সেচের খরচ ছিল চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু গত মৌসুমে তা ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া পানির স্তর এক ফুট নিচে নামলে কৃষিতে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় ৯০ কোটি টাকা। এক ফুট নিচে নামলে পানি ওঠাতে বেশি শক্তিশালী হর্স পাওয়ার পাম্প দিয়ে পানি তুলতে হয়। এতে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল বা বিদ্যুৎ ব্যবহূত হয়। এ কারণে বেড়ে যায় কৃষির উৎপাদন খরচ। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহরাপুর এলাকার কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, খরার সময় বাড়ির টিউবওয়েলেও পানি ওঠে না। ফসল উৎপাদনে গভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে সেচের খরচে শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লিটার পানি ব্যয় হয়। এই পানি মাটির গভীর থেকে ওঠাতে প্রতি বিঘার জন্য প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয় হয়।
খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো শুরু হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে টিউবওয়েল বসিয়েই পানি পাওয়া যেত। এখন ১৬০ ফুট বসিয়েও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএডিসির ২০১৬ সালের গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপে দেখা যায়, দেশের মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৪৮ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ ও খাবার পানি সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বছরের পর বছর গভীর নলকূপ বসিয়ে বোরো মৌসুমে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সাত উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।
৩৫ বছর ধরে দেশের পানি নিয়ে গবেষণা করছে এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, বৃষ্টির পরিমাণ কমে নদী শুকিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে সেচের পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে।
গবেষকরা বলছেন, গত ২০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে স্থানভেদে ৫ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে পানির স্তর। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি নির্ভরশীলতার কারণে ইতিমধ্যে পানির স্তর কোথাও কোথাও ৩ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সাধারণ নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
গত বছরের বিএডিসির ভূগর্ভস্থ পানির জোনিং চিত্র বলছে, সেচ মৌসুমে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় দেশের পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বের ৩১ জেলায় পানির স্তর প্রতি বছর পাঁচ ইঞ্চি থেকে আড়াই ফুট করে নিচে নামছে। তাদের ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ রয়েছে। ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি ওঠানো হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। আর উত্তোলিত পানির ৮৭ শতাংশ সেচ কাজে ব্যবহূত হচ্ছে।
অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছয় কোটি মানুষ। বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি সেচের ৮০ শতাংশ চাহিদা মেটায়। এর পরিমাণ হচ্ছে ৫৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। আর বাকি ২০ শতাংশ উপরিভাগের পানি থেকে আসে।
উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তাদের তথ্যমতে রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ৫-২৪ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়।
গত কয়েক বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের তিন জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। কোনো নীতিমালা না মেনেই এসব ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। এর ফলে পানির স্তর প্রায় ৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। এসব এলাকায় পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে শিল্প-কারখানায় পানির যথেচ্ছ ব্যবহার।
ওয়াটার এইডের পানি গবেষক ড. আনোয়ার সেলিম এ প্রতিবেদককে বলেন, বিগত শতকের সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল পুকুর, নদী, খাল আর জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষি কাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। নদীগুলোতে অপরিকল্পিত বাঁধ, জলবায়ুর প্রভাবে প্রতি বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও বন্যা না হওয়া এবং দুয়েক বছর পর পর তীব্র খরা হওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে সংকট প্রকট হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, এভাবে পানির স্তর নামতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়বে। শহর, গ্রাম এবং শিল্প এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে বৃষ্টি বা উন্মুক্ত জলাধারের পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এসআই খানের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে সেচ, খাওয়া ও শিল্পের জন্য পানি উত্তোলন করা হয়। এতে প্রতি বছর গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল ৫ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশে বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে এক মিটার পানি রিচার্জ হয়। এ ছাড়া বর্ষার বৃষ্টি ও বন্যায় বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতি বছর বৃষ্টি ও বন্যার পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতি বছর নিচে নেমে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ হামিদুর রহমান বলেন, দেশের কৃষক নদী-নালা, পুকুর ও খাল-বিলের (ভূ-উপরস্থ) পানি ব্যবহার করে আগে বোরো মৌসুমে সেচ দিত। এ পদ্ধতিতে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ। এখন ভূ-উপরি স্তরের পানি না পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। গত বছরের হিসাবে ৭৯ শতাংশ জমি মাটির নিচের পানিতে চাষ হয়। এর মধ্যে গভীর নলকূপ দিয়ে ১৫ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয়। প্রায় ৬৪ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় অগভীর নলকূপ দিয়ে।
এ বিষয়ে কৃষি, পানি ও পরিবেশ প্রকৌশলী এবং বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. ইফতেখারুল আলম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই দেশের কয়েকটি অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি অস্বাভাবিক হারে নামছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে সারাদেশে প্রায় ১০ হাজার খাল কাটা, নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। গত বছর যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও ভূ-অভ্যন্তরের পানি রিজার্চ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভূ-উপরি স্তরের পানির ব্যবহার না বাড়লে এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে না পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ভূ-উপরিভাগ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে পানি সমস্যা বাড়বে। এ জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। পানির অধিকারে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও কৃষি উৎপাদনকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভূগর্ভের পানি মজুদ রাখতে উপরিভাগের পানির ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করলে পানি নিয়ে বড় বিপদ খুব সন্নিকটে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, নদী-নালা, পুকুর, ডোবা ও হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পানি সংকট সমাধানে সরকার ডেল্টা প্ল্যান ও এসডিজি অর্জনে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে পানির অপচয় রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সূত্র: সমকাল

(ঊষার আলো-এমএনএস)