ঊষার আলো রিপোর্ট : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) হলে হলে খোলা হয়েছে রাজনৈতিক ব্লক। এসব ব্লকের রুমগুলো দখলে রেখে জাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের অনুসারীরা আয়েশি বসবাস করছেন। যাদের অধিকাংশই অছাত্র। একেকজনের দখলে রয়েছে একাধিক রুম। নিজে থাকার পাশাপাশি বানিয়েছেন অতিথি কক্ষও। অভিযোগ রয়েছে, কক্ষগুলোয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় অত্যাচারের স্টিমরোলার। এছাড়া মাদক, চাঁদাবাজির টাকাও ভাগবাঁটোয়ারা হয় কোনো কোনো রুমে বসে।
অন্যদিকে পোষ্য কোটায় ভর্তি শিক্ষার্থীদের হলের সিট পাওয়ার নিয়ম নেই। অথচ জাবিতে পোষ্য কোটায় ভর্তিদের একটি বড় অংশ ছাত্রলীগের ছায়াতলে থেকে দখলে রেখেছেন বিভিন্ন হলের রুম। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও তারা ছাড়ছেন না সিটের দখল। আর নিরীহ শিক্ষার্থীরা সিট বরাদ্দ না পেয়ে থাকছেন মিনি গণরুমে। এ নিয়ে তাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি হলের মধ্যে ১৯টি চালু আছে। এর মধ্যে ছাত্র হল ১০টি এবং ছাত্রী হল ৯টি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রদের প্রতিটি হলেই খোলা হয়েছে দুটি করে রাজনৈতিক ব্লক। একটিতে থাকছেন ছাত্রলীগ জাবি শাখার সভাপতির অনুসারী, অন্যটিতে সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা।
শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের জাবি ইউনিট সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল এবং সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন দখল করে রেখেছেন দুটি হলের ৫টি রুম। এর মধ্যে সভাপতি একাই দখলে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ৩২০ ও ৩২২ নম্বর কক্ষ। দুই কক্ষে আটজন শিক্ষার্থীর সিট রয়েছে। সাধারণ সম্পাদক লিটন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৪৭ ও ৩৪৯ নম্বর কক্ষের মোট আটটি সিট দখলে রেখেছেন। তারা রুমগুলো নিজেদের পছন্দমতো সাজিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, অছাত্রদের বের করার কাজ চলমান। হলের সিটের চেয়ে অ্যালোটমেন্টের (বরাদ্দ) সংখ্যা বেশি ছিল। এটিও সিট সংকটের একটি কারণ। যেই রুমগুলো অছাত্রদের দখলে ছিল, সেগুলোয় অ্যালোটমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি। কে কোন রুমে থাকছে, সেই ডেটাবেজ তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, পোষ্যদের ব্যাপারেও জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান বলেন, ‘অছাত্রদের বের করতে কাজ করছে প্রভোস্ট কমিটি। তারা সরাসরি উপাচার্য বরাবর রিপোর্ট করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও এ বিষয়ে তৎপর।
আমি তাদের একটি মিটিংয়ে ছিলাম। সেখানে কাজের অগ্রগতি দেখেছি। তবে আমার কাছে এ মূহূর্তে আপডেট তথ্য নেই।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. ইস্রাফিল আহমেদ বলেন, ‘অনেকদিনের একটা চর্চা হঠাৎ করে বন্ধ করা যায় না। তারপরও যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে এবং পোষ্য কোটায় ভর্তির পর হলে আছে তারা যেন হলে না থাকে, এ ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
যারা এক বা একাধিক কক্ষ দখল করে থাকছে, তাদেরও বলা হয়েছে। খুব দ্রুতই কক্ষগুলো আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেছি। সাবেক ছাত্ররা আমার কাছে এক সপ্তাহের সময় চেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তারা নিজেরাই হল ছেড়ে চলে যাবে। আশা করছি, এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সুন্দর একটা পরিবেশ উপহার দিতে পারব।’
৩ ফেব্রুয়ারি মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে জঙ্গলে নিয়ে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে ওই হলে অবৈধভাবে বসবাসকারী ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানসহ ছাত্রলীগের চার নেতা এবং অপর দুজনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল থেকে অছাত্র ও অবৈধদের ৫ কর্মদিবসের মধ্যে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যাম্পাসে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হয়েছে ১১ ফেব্রুয়ারি। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও সাতদিন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অবৈধভাবে বসবাসকারী আড়াই হাজার অছাত্রের মধ্যে প্রায় ৬৫০ জনকে বের করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিরা এখনো আছেন। তাদের হল থেকে বের করে দিতে হোঁচট খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যদিকে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গেটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ছাত্র জানিয়েছেন, জাবি ছাত্রলীগের কমিটিতে চার শতাধিক নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৩০০ নেতাই এখন অছাত্র। আর বাকিদের কেউ কেউ বিশেষ ছাত্র। অন্যদিকে কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে বহু আগে। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এবং তাদের অনুসারীদের দ্বারা জাবি এলাকায় ঘটছে নানা অপকর্ম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় এখনো ৪১ থেকে ৪৬তম ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। তাদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি ৪২তম ব্যাচের এবং সাধারণ সম্পাদক ৪৩তম ব্যাচের। সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে মাস্টার্সে ফেল করা বিশেষ ছাত্র। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনও মাস্টার্সে ফেল করা বিশেষ ছাত্র। লিটন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পোষ্য কোটায় ভর্তি হন।
শীর্ষ পদগুলো ছাড়াও অধিকাংশ নেতাকর্মীর ছাত্রত্ব নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিতে ১০৬ জনের মধ্যে অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। আর ১১ জন যুগ্মসম্পাদক এবং ১১ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের সবার ছাত্রত্ব শেষ। এছাড়া অন্যান্য পদেও অনেক অছাত্র নেতা রয়েছেন, যারা অবৈধভাবে আবাসিক হলে থাকেন।
ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও হলের সিট দখল করে রাখা অনেকেই ৪ জনের সিটের একটি কক্ষে দুইজন, দুইজনের কক্ষে একজন করে থাকছেন। কোনো কোনো হলে চারজনের কক্ষে একজন করে থাকেন।
জানা যায়, অছাত্রদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪১ ব্যাচের একজন, ৪২ ব্যাচের প্রায় ২০ জন, ৪৩তম ব্যাচে ২০০ জন, ৪৪তম ব্যাচের ২০০ জন, ৪৫তম ব্যাচের ১ হাজারের বেশি এবং ৪৬তম ব্যাচের ১ হাজারের মতো রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জাবির হলগুলোয় প্রায় ১২ হাজার সিট। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন। ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫০ জনকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের চাপ পড়ছে বৈধদের ওপর। সিট না পেয়ে মিনি গণরুমে এক কক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছেন ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী। এতে পড়াশোনাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য বলছে, জাবিতে ২০১৩-১৪ থেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ৫৭৯ জন শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হন। এর মধ্যে ৩১৩ জন পোষ্য শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, অধিকাংশ পোষ্যরা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অবৈধভাবে হলে থাকছেন। জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন নিজেই পোষ্য কোটায় ভর্তি হন। তিনিও হলের রুম দখল করে আছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, ৩২০ ও ৩২২ নম্বর কক্ষ দখলে রাখার বিষয়টি ঠিক নয়। এ দুই রুমে আটজন অ্যালোটেড শিক্ষার্থী রয়েছেন। তারা মাঝেমধ্যে এসে থাকেন।
আর আমি যখন যে রুমে খুশি, সেই রুমেই থাকি। সভাপতি ও সেক্রেটারির রাজনৈতিক ব্লক সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমমনারা একসঙ্গে থাকেন। এর বাইরে কিছু না। আমরা তো একই আদর্শের রাজনীতি করি। অন্যান্য আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নামে অবৈধ দখল সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে হল প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন হলের রুম দখলের প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেন, আবাসিক হলগুলোয় সিট সংকট আছে। এটা দূর করতে এবং অছাত্রদের বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা চেয়েছে। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমরাও চাই যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে, তারা হলগুলোতে না থাকুক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। প্রত্যেক গেটেই আমরা নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে রেখেছি।
ঊষার আলো-এসএ