ঊষার আলো রিপোর্ট : দ্রুত নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন-রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ক্রমে এই বক্তব্য জোরদার হচ্ছে। দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ চাইছে। সমমনা দলগুলোও একই দাবি জানাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী সংস্কারে গুরুত্ব দিলেও বিলম্বিত নির্বাচন চায় না। পতিত স্বৈরাচার সরকারের সুবিধাভোগীদের অপতৎপরতা, নানামুখী সংকট, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলনসংক্রান্ত পরিস্থিতি দলগুলোর মধ্যে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ বাড়িয়েছে-এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
যদিও সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সরকার কোনো দলের কাছে নয়, জনগণের আকাঙ্ক্ষার কাছে দায়বদ্ধ। তাই বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের জন্য যতই চাপ দিক, সংস্কার কমিশনের কাজের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচনের দিকে এগোবে সরকার।
বিএনপি মনে করে, ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনি প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। বিএনপির সঙ্গে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের স্পষ্ট ঘোষণা চায়। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তাই নির্বাচন নিয়ে সরকার কী ভাবছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের কেউ কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আবার কেউ বলছেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়া না হলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন সম্পর্কিত সংস্কার কার্যক্রম, নির্বাচনি রোডম্যাপ ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচনমুখী সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্য নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়া জরুরি। তাতে করে জনগণ বুঝতে পারবে, তারা একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষ আরও বুঝতে পারবে, নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে তারা কবে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সব সংস্কার কার্যক্রম সমাপ্ত করতে গেলে এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে হবে, সেটা তো সম্ভব নয়। এমনটা হলে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। আমরা মনে করি, সরকার নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, তারা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছেন। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু সংস্কার কার্যক্রম করতে হবে। তবে নির্বাচন কবে হবে, এ ব্যাপারে সরকারের একটি রোডম্যাপ দেওয়া উচিত। দেশে বর্তমানে কিছু কিছু সংকট রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক সংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে এগুলো কেটে যাবে; বিনিয়োগ আসবে, বাজার স্থিতিশীল হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটবে।
জামায়াতে ইসলামীও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে সংস্কারকেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে নির্বাচনই একমাত্র সমাধান বলে ভাবছে দলটি। বিএনপির শরিকরাও দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা চায়। তারা নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
শনিবার মানিকগঞ্জে এক কর্মী সম্মলনে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পাদন করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। সংস্কার না করে যেমন নির্বাচন দেওয়া যাবে না, আবার খুব বেশি বিলম্ব করাও যাবে না। কারণ বিলম্ব করলে ফ্যাসিস্টরা ফিরে আসার পাঁয়তারা করবে। সম্ভব হলে ডিসেম্বরের পরেই নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে একটি নির্বাচন আয়োজন করা। এজন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যাতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। তাই নির্বাচনমুখী সংস্কারকে এখন প্রাধান্য দিতে হবে। রাষ্ট্রের সব সংস্কার করা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তা ছাড়া মানুষও এখন ভোট দিতে উদগ্রীব। তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, সেটা ঠিকই আছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এজন্য নির্বাচন কমিশন গঠন ও প্রশাসন তৈরি করতে হবে। এটা করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা নয়।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ৩ মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এখন অবিলম্বে তাদের নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। দেশবাসীর প্রত্যাশা, সরকার নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। কারণ, বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণ এখন ভোট দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল মনে করেন, নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি যৌক্তিক। সরকারের ওপর নির্বাচনি চাপ বাড়ছে-এটাই স্বাভাবিক। সরকারের উচিত একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়া। না দেওয়ার পেছনে আমি তো কোনো যুক্তি দেখি না। উনারা সংস্কার করতে চাইছেন, করুন। যতগুলো করতে চান কাজ করেন। কিন্তু সবগুলোর জন্য তো একটা টাইম লিমিট থাকবে। আপনি তো অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এগুলো করতে পারেন না। কাজেই তাদের উচিত একটা রোডম্যাপ দেওয়া যে, আমাদের এটা করতে এতদিন লাগবে, সংস্কারের জন্য এতদিন লাগবে, ভোটার তালিকা করতে এতদিন লাগবে। যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে, এখন যদি রোডম্যাপ ঘোষণা না করা হয় তাহলে কমিশনের কাজটা কি হবে? তারা বলবে না যে এক বছরের মধ্যে নির্বাচন করতে চাই বা ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন করতে চাই। রোডম্যাপ তো ঘোষণা করতেই হবে, কিন্তু তা করছেন না কেন?
তিনি আরও বলেন, আগে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো চাপটা দিত না এ কারণে যে, আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ সরকারের প্রতি এক ধরনের নিরঙ্কুশ একটা আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, এটা এখন ধীরে ধীরে কমছে। এই কমার কারণে বিএনপিসহ সমমনারা মনে করছে তারা নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে চাপ দেবে, যাতে করে আগামীতে নির্বাচন দিলে ক্ষমতায় আসতে পারবে। হিসাবটা কিন্তু পরিষ্কার। এখন সরকার যদি ভালোভাবে দেশ চালাতে পারত, সরকারের ওপর মানুষের যদি কোনো ক্ষোভ না থাকত তাহলে হয়তো এই চাপটা এতটা তীব্র হতো না।
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ মনে করেন, একদলীয় শাসনের জাঁতাকলে নাগরিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াগুলো হাজির করার সুযোগও সীমিত ছিল, যেগুলো সব এখন সামনে আসছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তি আওয়ামী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত যথেষ্ট সবর ও কৌশলের সঙ্গে ৭০-এর অধিক আন্দোলন/দাবি-দাওয়াকে শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে, যার জন্য তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। নির্বাচন হলেও এসব সমস্যার আশু সমাধান হবে না, কারণ আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য যে ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তা দেশে বর্তমানে অনুপস্থিত। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রক্রিয়া জারি রাখা জরুরি।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তা নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোরও আগ্রহ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল মনে করেন, কূটনীতিক চাপও আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের (প্রধান উপদেষ্টা) যে কয়েকটা সাক্ষাৎকার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আসছে, প্রত্যকটাতেই দেখবেন একটা প্রশ্ন কমন। সেটা হলো আপনি কবে নির্বাচন দেবেন, অথবা অপনারা কতদিন থাকতে চান। এই প্রশ্ন সবার মধ্যে কেন কমন? প্রত্যেকটি দেশের মিডিয়া এই কথাটা জানতে চাইছে কেন? এটা কি একটা চাপ নয়?
তবে ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ মনে করেন, নির্বাচন বিষয়ে সারা দুনিয়ার বড় ধরনের চাপ আছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হয়নি। কারন অধ্যাপক ইউনুস নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার সংস্কার ও নির্বাচনের পথরেখা পরিষ্কার করেছেন।
ঊষার আলো-এসএ