UsharAlo logo
সোমবার, ১৪ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রফেসর ইউনূসের ব্যাংকক জয়

ঊষার আলো
এপ্রিল ৭, ২০২৫ ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের চীন সফরের মতো থাইল্যান্ড সফরও সফল হলো। তিনি বিমসটেক সম্মেলনে অংশ নিতে দুদিনব্যাপী (৩-৪ এপ্রিল, ২০২৫) থাইল্যান্ড সফর করেন। সফরের প্রথম দিন তিনি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরামে বক্তব্য রাখেন। ওই অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক (কী নোট স্পিকার) তিনিই ছিলেন। প্রফেসর ইউনূস সেখানে বলেন, ‘পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে তরুণ প্রজন্মকে ‘থ্রি-জিরো ব্যক্তি’ হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। যদি আমরা টিকে থাকতে চাই তাহলে আমাদের নতুন ‘থ্রি-জিরো’ সভ্যতার দিকে যেতে হবে। শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য বর্জ্য এবং শূন্য সম্পদ কেন্দ্রিকতার দিকে যেতে হবে। প্রকৃতির সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘আপনার সম্পদ যদি ভাগাভাগি না করেন, তাহলে সমাজে টিকে থাকা সম্ভব নয়।’ তরুণদের উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে তৈরির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে অন্যের অধীনে ‘কাজ করার জন্য নয় বরং উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য।’

প্রধান উপদেষ্টার এসব কথা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট প্রচারিত হয়। পরদিন তিনি বিমসটেকের মূল সম্মেলনে অংশগ্রহণের ফাঁকে সাইডলাইনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভুটান ও মিয়ানমারের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে আলাদা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন। থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমনবিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়। তিনি শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের চুরি হওয়া অর্থ ফেরাতে সেদেশের সহায়তা চান। মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের জন্য প্রাণহানির ঘটনায় দেশটির জনগণের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশ করেন। দুর্যোগ মোকাবিলায় মিয়ানমারে বাংলাদেশি উদ্ধারকারী দল মোতায়েনের পাশাপাশি বাংলাদেশের দেওয়া মানবিক সহায়তা প্রদান নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা আরও মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত। আমাদের জাহাজ প্রস্তুত।

প্রফেসর ইউনূসের সব সাক্ষাৎ ও বৈঠকের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ৪০ মিনিটব্যাপী বৈঠক। কেননা হাসিনা-পরবর্তী যুগে এটাই ছিল ইউনূস-মোদি প্রথম বৈঠক এবং তা বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত শীতল সম্পর্কের মাঝেও সংঘটিত হতে পারল। ওই বৈঠকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তবে এ বৈঠক সত্ত্বেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারত শেখ হাসিনাকে কখনোই বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে না। কারণ বাংলাদেশ বিষয়ে ভারত কী ধরনের নীতি অবলম্বন করে চলবে, তা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভাগ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারত অতীতে এবং এখনো বেশ খোলামেলাভাবেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে। ভারত ও আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্পর্ক ৫৪ বছরের পুরোনো। যা-ই হোক, বাংলাদেশ-ভারত বর্তমান বৈরী সম্পর্কের মাঝে ইউনূস-মোদি বৈঠক বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। এখন ভারত অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার তথা বাংলাদেশের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে এগিয়ে আসবে কিনা, তা দেশটির নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপার। তবে ড. ইউনূস নরেন্দ্র মোদিকে অন্তত এ কূটনৈতিক বার্তা দিতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশ অকারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কহানি করতে চায় না।

এবার বাংলাদেশ পরবর্তী দুই বছরের জন্য বিমসটেকের সভাপতিত্বের দায়িত্ব লাভ করেছে। কিন্তু বিমসটেক আসলে কি? ১৯৯৭ সালে ভারতের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বিমসটেক। ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সদস্য রাষ্ট্র। ইংরেজি ইওগঝঞঊঈ শব্দের পূর্ণরূপ হলো, The Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation. যার বাংলা অর্থ : বঙ্গোপসাগরীয় বহুখাতীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উদ্যোগ। এ উপ-আঞ্চলিক জোটের বয়স ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও জোটটি থেকে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো এ পর্যন্ত কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। ভারতের কারণে এ জোটটি মূলত হয়ে আছে ঠুঁটো জগন্নাথ। ১৯৮৫ সালে গঠিত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্ক। সার্ককে ঘিরে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা মূলত ভারতের কারণেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ২০১৪ সাল থেকেই ভারত সার্ককে অকার্যকর করে ফেলে। এরপর ২০১৫ সালে ভারতের উদ্যোগে আরেকটি উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপাল হয় এর সদস্য রাষ্ট্র। বিমসটেক এবং বিবিআইএন, এই দুই উপ-আঞ্চলিক জোট ভারতের পূর্ণ প্রভাব দ্বারা পরিচালিত। ফলে এ দুই জোটের সদস্য হয়ে বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত উপকৃত হতে পারেনি। সার্কের আটটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এই চার মুসলিম দেশ। এটি সার্কের প্রতি ভারতের অস্বস্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু সার্ককে কার্যকর ও সক্রিয় করা গেলে তা দ্বারা উপকৃত হতে পারবে ভারতসহ এর প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রগুলোও।

বাংলাদেশের প্রয়োজন বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি। এটি অবলম্বনের সুযোগও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানের সদস্য হতে পারে। আসিয়ানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো শক্তিশালী দুই মুসলিম সদস্য রাষ্ট্র। ভারত ও মিয়ানমারের প্রভাব মোকাবিলায় আসিয়ান হতে পারে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম এক উপযুক্ত ফোরাম। ৪ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংকার, শিক্ষাবিদ এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের সঙ্গে এক প্রাতঃরাশ বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে তিনি আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে ঢাকার প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থনদানের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আশা করছে আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জনে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানের শীর্ষ দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া যাবে।

এদিকে ওই একইদিন ব্যাংককে ই-বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠককালে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানকে জানান যে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য চিহ্নিত করেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে নিশ্চয়তা দিয়েছে মিয়ানমার। আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলমান রয়েছে। এভাবে এই প্রথম মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ একটি নিশ্চিত প্রত্যাবর্তনের তালিকা প্রদান করল, যা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এর আগে বিমসটেকের মূল সম্মেলনে বক্তৃতা দানকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে পুরো অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। বিমসটেক এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ সব সময় উন্মুক্ত আঞ্চলিক সহযোগিতার পক্ষে। আমরা এমন একটি অঞ্চল গঠনের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সব দেশ সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক স্বার্থ ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য কাজ করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিমসটেক অঞ্চল বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। অনেকেই এ বিশাল জনসংখ্যাকে ‘সমস্যা’ হিসাবে দেখলেও সঠিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এ জনসংখ্যাই সবচেয়ে বড় সম্পদে পরিণত হতে পারে। নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও সঠিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এ অঞ্চল বিশাল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে।’

এবারের বিমসটেক সম্মেলনের একটি বিশেষ অগ্রগতি হলো মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যাতে বিমসটেকের সাত সদস্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সই করেছেন। বিমসটেকের এই ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন শেষে নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার আগে ব্যাংককে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। উল্লেখ্য, সাবেক থাই প্রধানমন্ত্রী থাকসিন ২০০১ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে থাইল্যান্ডের জন্য একটি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির নকশা তৈরি করেন। ওই বছর জাতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে অধ্যাপক ইউনূসকে থাকসিন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

এভাবেই বিমসটেক সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থাইল্যান্ড সফর শেষ হয়। আর ওই সফরে সাত সদস্য রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের মধ্যে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন আগ্রহ ও আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনে বিরাট সম্মান। এত বছর যে সম্মেলন ভারতের ছায়ায় ঢেকেছিল, তা যেন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশময়। এটাই হলো বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ফলাফল।

ঊষার আলো-এসএ