ঊষার আলো রিপোর্ট : শিক্ষাদান (টিচিং), গবেষণা (রিসার্চ), গবেষণা-উদ্ধৃতি (সাইটেশন), আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি (ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক) এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম (শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময়) ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট এবং অন্য ১৩টি নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে ১০০ নম্বরের একটি র্যাংকিং তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই)-২০২৪। বিশ্বের ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৯০৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ তালিকায় সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে।
এগুলো হলো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। এছাড়া ১২০১ থেকে ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় প্রথম ৮০০’র মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অথচ গত বছরের এ তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১ থেকে ৮০০-এর মধ্যে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তালিকার এ উত্থান-পতন কেন, কিংবা কী উদ্যোগ নিলে তালিকার শীর্ষে থাকা যায় এ নিয়েই আজকের লেখা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। সে হিসাবে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির বয়স ১০২ বছর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স যথাক্রমে ৭০ ও ৫৭ বছর। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখন ৫২ বছর। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স এক থেকে চল্লিশ বছরের মধ্যে। ১৯৯২ সালে দেশে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ হলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরপরই প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ১৯৯৬ সালে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ২০০১ সালে।
এরপর ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ড্যাফোডিল, অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বিইউবিটিসহ ১১৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর কোনো কোনোটির বয়স ত্রিশ বছর পার হলেও অধিকাংশের বয়স অনেক কম। কিন্তু বয়সে নবীন হলেও গত কয়েক বছর ধরে টিএইচই বা কিউএস র্যাংকিংয়ে নর্থ সাউথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সম্মানজনক অবস্থানে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান র্যাংকিং তালিকায় শীর্ষে যেতে পারছে না কেন?
র্যাংকিং প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষার মান, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শ্রেণিকক্ষে আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, লিঙ্গের সমতা, শ্রেণিকক্ষে, ল্যাবে আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রাচুর্য ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। শিক্ষকদের গবেষণার মান, আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা, বাণিজ্যিক বাজারে এসব গবেষণার চাহিদা, কর্মমুখী শিক্ষা, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্কিত আধুনিক কারিকুলাম, দেশি-বিদেশি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, ক্রেডিট ট্রান্সফার, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি পর্যালোচনা করে। অবকাঠামো, ছাত্রাবাস, গবেষণাগার, উন্নত যাতায়াত ও চিকিৎসাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস, ছাত্র সংসদ ইত্যাদি বিষয়ও হয়তো আমলে নেয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব, দ্রুত গতির ইন্টারনেট, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, শিক্ষার্থীর আসন অনুপাতে শ্রেণিকক্ষ এবং ছাত্র-শিক্ষকের আনুপাতিক হার সন্তোষজনক। সেখানে ছাত্র রাজনীতি ও মিছিল-মিটিং নেই, নেই কোনো সেশনজট। সেখানে বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পদচারণা রয়েছে এবং সহজেই তারা ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ পান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীর সব কার্যক্রম যেমন-টিউশন ফি, বৃত্তি, মাসিক বেতনসহ সব ব্যাংকিং লেনদেন অনলাইন কিংবা অ্যাপস দিয়ে পরিচালিত হয়। টার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে লেখাপড়া সমাপ্ত করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। অর্থাৎ র্যাংকিং নির্ধারণের অধিকাংশ খাত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত ক্যাম্পাস হওয়ায় সেখানে শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অবাধ চলাফেরা, খেলাধুলা, বিতর্ক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চলে স্বাধীনভাবে। কিন্তু সেখানে উন্নত ল্যাব সরঞ্জাম, দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং ইন্টারঅ্যাক্টিভ ডিজিটাল ক্লাসরুম নেই বললেই চলে। বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রায় শূন্য। শ্রেণিকক্ষে থাকে আসনের বিপরীতে দেড়গুণ-দুইগুণ শিক্ষার্থী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারও হতাশাব্যঞ্জক। থাকে ঈদ-পূজা, গ্রীষ্ম ও শীতকালীন লম্বা বন্ধ। সেখানে সবার জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সরাসরি দেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তারা একই গ্রুপের মধ্যে দল-উপদলে বিভক্ত। ছাত্র রাজনীতির মিছিলে সভাপতি ও সেক্রেটারি গ্রুপের মধ্যে শোডাউন, হোন্ডা মিছিল, চেয়ার ছোড়াছুড়ি, মঞ্চ ভাঙচুর, উন্নয়ন কাজের নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজের জন্য কন্ট্রাক্টরকে জিম্মি করা, বিভিন্ন দাবিতে অফিস ও শ্রেণিকক্ষে তালা দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অজুহাতে নির্দিষ্ট তারিখে পরীক্ষা পরিচালনা করা যায় না। চার বছরের অনার্স ডিগ্রি শেষ করতে ৫-৬ বছর লেগে যায়।
টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই)-২০২৪ প্রকাশ হওয়ার পর (২ অক্টোবর ২০২৩) বিভিন্ন পত্রিকার খবরে শিরোনাম হয়েছে ‘শিক্ষা ও গবেষণায় দেশসেরা জাবি’। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যেও লক্ষ করা যাচ্ছে খুশির আমেজ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাব হলো, গত দুই বছর যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটসহ অফিশিয়াল কাজগুলো ডিজিটাল করা হচ্ছে, শিক্ষকদের গবেষণা তালিকা, গবেষণার বিষয় ইত্যাদি ওয়েব পেজে আপডেট করা হয়েছে, যা সর্বদা চলমান। সারা বিশ্বের ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর মধ্যে ৭-৮ জন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এ ছাড়া এখানে আছে স্বনামধন্য কীট বিশেষজ্ঞ, বন্যপ্রাণী, প্রজাপতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ দল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্লাজমা ফিজিক্স গবেষক প্রফেসর এএ মামুনের সাইটেশন ২০ হাজারের কাছাকাছি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। এখানে প্রতিবছরই শিক্ষকদের গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে, স্থাপন করা হচ্ছে স্মার্ট ও ভার্চুয়াল ক্লাসরুম। ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজিতে (আইআইটি) বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আনার চূড়ান্ত নীতি একাডেমিক কাউন্সিল থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বিভাগেও এ প্রক্রিয়া চলমান। বিদেশি শিক্ষকদের জন্য আধুনিক গেস্ট রুম এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী না থাকায় এ খাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং তালিকায় শূন্য নম্বর পেয়েও দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এ হিসাব প্রযোজ্য।
দেশে এখন ৫৩টি সরকারি এবং ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। দু-চারটি ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপরোক্ত সমস্যাগুলো তীব্রভাবে বিদ্যমান, যার সমাধান করা অতীব জরুরি। ভবিষ্যতে নির্মিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের সমস্যা যাতে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করবে।
ঊষার আলো-এসএ