UsharAlo logo
শুক্রবার, ১০ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ম্যাডাম বললেন, ‘হাসিনা আমাকে জেলে না নিয়ে ছাড়বে না’: মারুফ কামাল খান

usharalodesk
জানুয়ারি ১০, ২০২৫ ৪:০৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট :  বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার তথ্য, প্রমাণ এবং আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দির সংকলনে রচিত ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশান বিএনপি চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।

বইটি সম্পর্কে ওই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০১৮ সালে প্রকাশিত এই বইটির সম্পাদনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মরহুম অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। এছাড়া তার সহযোগিতায় ছিলেন বিএনপির কয়েকজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

তবে এই বইটি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে নিজের আক্ষেপের কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন খালেদার জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব সাংবাদিক মারুফ কামাল খান।

ওই পোস্টে তিনি দাবি করেন, অজ্ঞাত স্থানে বসে প্রায় তিন মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি এই বইটি লিখেছিলেন। এই কাজে তিনি কারো কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাননি।

ফেসবুকে দেওয়া মারুফ কামাল খানে স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

আমার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই ভার্চুয়াল বলয়ে যুক্ত ওয়াসিম ইফতেখারুল হক। আমার স্নেহভাজন এ তরুণ তুখোড় জাতীয়তাবাদী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। মধ্যাহ্নভোজে বসেছি। এ সময়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারে এলো তার এক ক্ষুদে বার্তা। ওয়াসিম জানাল, তারা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ নামে একটি বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আছে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমার প্রশংসা করেছেন।

কৌতূহল হলো। খেয়ে উঠে মেসেঞ্জারেই ফোন দিলাম ওয়াসিমকে। প্রবল আবেগে উচ্ছ্বসিত সে। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আদালতে দেওয়া খালেদা জিয়ার দুটি জবানবন্দি মিলিয়ে ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে হাসিনার শাসনামলে ওরা কয়েকজনে মিলে একটা বই বের করেছিল। প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ একটি মুখবন্ধও লিখে দিয়েছিলেন।

আমি যতদূর জানি, ঢাকার কোনো ছাপাখানা বইটি ছাপতে রাজি হয়নি। পরে ওরা সিলেট থেকে বইটি ছাপিয়ে ঢাকায় আনার উদ্যোগ নেয়। বই নিয়ে রেলগাড়িতে করে আসার পথে র্যাব একজনকে গ্রেফতার করে এবং সব বই সিজ করে নিয়ে যায়। এর সূত্র ধরে ওয়াসিমসহ গ্রেফতার হয় চারজন। ভয়ংকর অপরাধ নিবারণের উদ্দেশ্যে গঠিত র্যাবকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিম এভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের কাজেও অপব্যবহার করেছে। আটক চারজনকে র্যাব প্রায় দুই সপ্তাহ গুম করে রাখে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। সাড়ে ছ’মাস করে জেল খাটার পর জামিনে ছাড়া পায় তারা।

ফ্যাসিবাদমুক্ত স্বদেশে সেই বইটি ওরা ফের ছেপে বের করেছে। আজ গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে ছিল তার প্রকাশনা অনুষ্ঠান। সেখানে সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান সহ অনেকেই কথা বলেছেন। মির্জা আলমগীর তার বক্তৃতায় জবানবন্দি রচনায় আমার অবদানের কথা স্মরণ করে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেসসচিব, সাংবাদিক মারুফ কামাল খান বিভিন্ন কারণে আমাদের সঙ্গে নেই। তবে এই জবানবন্দি রচনায় তার অবদানের কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় করা হবে।

মারুফ কামাল খান বলেন, ধন্যবাদ আলমগীর ভাই। ভদ্রলোক মানুষ। রাজনীতিতে সৌজন্য যখন বিরল তখন মির্জা আলমগীর যে খানিকটা ব্যতিক্রম, তা অস্বীকার করার জো নেই। তিনি আমাকে যেটুকু কৃতিত্ব দিয়েছেন, সেটুকুই বা কজন দেয়? জ্বি হ্যাঁ, ওই দুটি জবানবন্দি আমার অক্ষম হাতেই রচিত। এই সুযোগে সেই গল্পটা একটু বলে নিই।

ম্যাডাম জিয়ার গুলশান অফিসে তার সঙ্গে টানা তিন মাস আমাকেও আটক থাকতে হয়েছিল হাসিনার শাসনকালে। এ সময়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। কয়েক মাস হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিই। আটক ও হাসপাতালে থাকা অবস্থায় হাসিনা সরকারের বদান্যতায় শ’খানেক মিথ্যে মামলার আসামি হই। খুন-জখম, অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি, ভাঙচুর, লুটতরাজসহ এহেন অপরাধ নেই যা আমি করিনি আটকা পড়া অবস্থায় এবং হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়ে। পুলিশ আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

যায় হোক এক সন্ধ্যায় শিমুল বিশ্বাস আমার গুপ্ত নম্বরে ফোন করে জানাল, ম্যাডাম জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বলেছেন। লুকিয়ে চুরিয়ে পুলিশ-গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গেলাম। ম্যাডাম জিয়া বললেন, দুটি মামলায় আদালতে আমি যে জবানবন্দি দেব তা আপনাকে লিখতে হবে।

আমি বললাম, ‘ম্যাডাম আমার আইন জ্ঞান খুব সীমিত। আমি কি পারব?’ তিনি বললেন, ‘আপনিই পারবেন। আমাদের লইয়াররা সাহায্য করবে।’ এই আস্থার পর না করার উপায় আছে? রাজি হলাম। আইনজীবী সানাউল্লাহ্ মিয়া ও মাসুদ তালুকদার মামলার সব কাগজপত্রের কপি আমাকে দিলেন। এরপর আয়োজন হলো ম্যাডামের সামনে বসে আইনজীবীরা আমাকে ব্রিফ করবেন। আমি নোট করে নেব। উঃ সে যে কী মর্মান্তিক অবস্থা!

উকিল-ব্যারিস্টার সাহেবরা পরস্পরবিরোধী মতামত দিয়ে বাদ বিসংবাদ শুরু করলেন। কে কত বড় পণ্ডিত তার বহর দেখাতে লাগলেন ম্যাডামের সামনে। আমি বুঝে গেলাম তাদের বেশির ভাগই মামলার ব্যাপারে কোনো স্টাডিই করেন নি। তারা ম্যাডামকে খুশি করার জন্য ‘প্লে টু দ্য গ্যালারি’ করছেন। আমার অস্বস্তি টের পেয়ে ম্যাডাম আইনজীবীদের বললেন, আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতামত মারুফের কাছে লিখিতভাবে দেন।

এরপর দেখলাম তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। একমাত্র রেজ্জাক খান তার এক পৃষ্ঠার কম্পোজ করা মতামত আমাকে দিলেন। বাকিরা বললেন, আপনি লিখে শেষ করুন। পরে ম্যাডামের সামনে আমরা শুনে আমাদের মতামত দেব। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন জবানবন্দি দুটি যেন খুব দীর্ঘ হয়। ম্যাডাম যাতে আদালতে এক বছর ধরে সেটি উপস্থাপন করতে পারেন। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম।

মামলার সব কাগজপত্র পুরো স্টাডি করে অজ্ঞাতস্থানে বসে প্রায় তিন মাস ধরে কঠোর পরিশ্রমে জবানবন্দি দুটি লেখা শেষ করলাম। এরমধ্যে কারো কাছে থেকে একবিন্দু সহায়তাও পাইনি। লেখা শেষে ম্যাডামের কাছে গিয়ে বিস্তারিত খুলে বললাম। তিনি বললেন, আপনি মোহাম্মদ আলী সাহেবের কাছে যান। পুরোটা যাতে উনি ভালো করে দেখে দেন। আমি উনাকে বলে রাখব।

আলী সাহেবের চেম্বারে পরপর তিন দিন আমাকে যেতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে আমি আমার লেখা জবানবন্দি পড়েছি, মোহাম্মদ আলী সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং তার মতামত নিয়েছি। তার আইনি পরামর্শে আমি কয়েক জায়গায় জবানবন্দি দুটি সংশোধন করি। এরপর সব চূড়ান্ত করে ম্যাডামের কাছে উপস্থাপনার পালা।

এখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তখনকার বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামানের ওপর ম্যাডামের আস্থা ছিল। ম্যাডাম তাকে পছন্দ করেন। আসাদ আমারও প্রিয়ভাজন। ম্যাডামের সামনে পড়ার সময় তিনি একমাত্র আসাদকে উপস্থিত রাখেন। আমাকে কয়েকবার করে পড়তে হয়। ম্যাডাম দুই-তিন জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করতে বলেন। আসাদও গ্রহণযোগ্য কিছু মতামত দেন। সবকিছু ইনকর্পোরেট করে দু’-তিন দিনের মধ্যে ম্যাডামের হাতে চূড়ান্ত কপি তুলে দিই। এই জবানবন্দি দুটি রচনায় এর বাইরে আর কারো কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

জবানবন্দি রচনার এই গল্প শেষ করার আগে ম্যাডাম জিয়ার দুরদর্শিতায় আমার বেদনাহত হওয়ার ঘটনাটা এখন বলি। আমি চলে আসব এমন সময় ম্যাডাম বললেন, আরও দুটি কাজ করে দিতে হবে আপনাকে। কী কাজ জানতে চাইলে তিনি বললেন, যত সুন্দর জবানবন্দিই লিখে দেন কোনো কাজ হবে না। বিচারকের কোনো ক্ষমতা নেই আমার মামলার রায় দেওয়ার। রায় দেবে মূলত হাসিনা। সে আমাকে জেলে না নিয়ে ছাড়বে না। আমি তাকে চিনি। কাজেই রায়ের আগে আমি একটা প্রেস কনফারেন্স করব সেটা আপনাকে লিখতে হবে। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একটা বক্তৃতাও আমি করব। এর জন্য একটা টকিং পয়েন্টসও লাগবে। আপনি প্রস্তুতি নিয়েন।’

আমি মন খারাপ করে চলে এলাম। কয়েক মাসের মধ্যেই ম্যাডামের জন্য সেই প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য এবং সভার বক্তব্যের টকিং পয়েন্টস আমাকে লিখতে হয়েছিল। আমি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে গভীর বেদনাহত হয়ে দেখতে পাই, ম্যাডামের ভবিষ্যদ্বাণী শতভাগ ফলে গিয়েছিল।

ঊষার আলো-এসএ