ঊষার আলো রিপোর্ট : ক্রেতার স্বার্থে নয়, সিন্ডিকেটের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্যবসায়ীদের কথামতো দুই ধাপে শুল্ককর কমালেও গত এক মাসে ভোজ্যতেলের দাম ভোক্তা সহনীয় করতে পারেনি। বরং দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও করেছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিজেরাই বাড়িয়েছে দাম। সর্বশেষ সরকারিভাবে লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হলেও মাসব্যাপী ২৮ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি করেছে।
বুধবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, সরকারি হিসাবে বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ২২ লাখ টন। এতে দেখা গেছে, এক মাসে তেলের দরকার হয় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৩ টন। একদিনে তেল লাগে ৬ হাজার ১১১ টন। লিটার হিসাবে দিনে ৬১ লাখ ১১ হাজার ১১১ লিটার তেলের দরকার হয়। সেক্ষেত্রে লিটারে ২৮ টাকা বেশি দরে বিক্রি হলে, মাসে ভোক্তার পকেট থেকে লুট হয়েছে ৫১৩ কোটি টাকারও বেশি।
এদিকে এই টাকা লুট করেছে সেই চিহ্নিত ব্যবসায়ীরা বলে মন্তব্য করেছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন। তিনি জানান, সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর আগেই কোম্পানিগুলো এক মাস আগ থেকেই লিটারে প্রায় ২৮ টাকা বেশি দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করেছে। সে হিসাবে ৫০০ কোটি টাকার বেশি টাকা মাসের ব্যবধানে ভোক্তার পকেট থেকে লুট করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এই লুটপাটের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। কিন্তু সরকার ক্যাবের কথা শুনতে চায় না। আগে শেখ হাসিনার সরকারও শোনেনি। এবারের সরকারও শুনছে না। কিন্তু ঠকছেন ভোক্তা।
ভোজ্যতেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, কয়েকদিন থেকে আমরা কীভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করেছি। বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ১২০০ ডলারে উঠেছে। গত এপ্রিলে সরকার যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ছিল ১০৩৫ ডলার। এখন ১১০০ ডলার ধরে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ১০৫ ডলার। গত আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১ ডলারে, সেপ্টেম্বরে আবার কিছুটা বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে সার্বিকভাবে দাম নিম্নমুখী। গত ডিসেম্বরের তুলনায় সয়াবিনের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহণ খরচ কমেছে। দেশে ডলারের দামও কমেছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার কিনতে হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করে। এখন তা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা। কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে ও বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানিতে দুই দফায় শুল্ককর কমানো হয়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে। অর্থাৎ লিটারে শুল্ককর কমেছে ১০-১১ টাকা।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে কিছুদিন হলো। আর এখন যে সয়াবিন তেল দেশের বাইরে থেকে আনতে হয়, মালয়েশিয়া থেকে আনতে হলেও দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। ব্রাজিলসহ অন্যান্য জায়গা থেকে এলে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারের যে অজুহাত দেখানো হলো, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। পাশাপাশি শুল্ক কমানোর সুফল ভোক্তারা পায়নি। এই বিষয়গুলো কোনোভাবে উপস্থাপিত হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে মজুত পর্যাপ্ত, কিন্তু সরবরাহ চেইনে সমস্যা। তবে কথা হচ্ছে, সরকার জানলেও সরবরাহ চেইনে সমস্যা সমাধান করেনি। তদারকি করে ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ব্যবসায়ীদের ফাঁদে সরকার পা দিয়েছে। এতে সরকার ভোক্তার কাছ থেকে আরও বিপুল পরিমাণে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাহলে আগের সরকারের সঙ্গে এবারের সরকারের কোনো পার্থক্যই থাকল না। আগের সরকার যে পথে হেঁটেছে, এবারের সরকার সেই একই পথে হাঁটছে।
এদিকে দুদিন আগে লিটারে ভোজ্যতেলের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছে। সেক্ষেত্রে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা লির্ধারণ করা হয়েছে। খোলা সয়াবিন তেলের দাম ধরা হয়েছে লিটারে ১৫৭ টাকা। আর পাম তেলের খুচরা মূল্য দেওয়া হয়েছে ১৫৭ টাকা। তবে বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়ালেও মূল্য কার্যকর করা হয়নি। এখানেও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করছে। বোতল তেলের মূল্য ঠিক রাখা হলেও খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৮৫ টাকা। এই একই দামে এক মাস ধরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা সোহেল বলেন, সরকার নতুন মূল্য নির্ধারণ করেছে। পাঁচ লিটারের তেল ৮৩৭ টাকা কিনে ৮৫২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। দুদিক থেকে লাভ করছে কোম্পানিগুলো। তিন লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৫১৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বিক্রি করতে হচ্ছে ৫২৫ টাকায়। খোলা সয়াবিন লিটারপ্রতি ১৮৮ টাকায় ডিলারদের কাছে কিনতে হয়। বিক্রি করতে হচ্ছে ১৮৫ টাকা। এই দাম গত কয়েক মাস থেকে চলছে। পাম অয়েল ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিনতে হচ্ছে ১৭১ টাকায়।
তিনি জানান, ডিলাররা এখনো তেলের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক করেনি। সরকারি মূল্যের বাড়তি দামে বিক্রির জন্য তারা এখনো সংকট সৃষ্টি করে রেখেছে। এক লিটারের তেল এখনো ডিলাররা দেয়নি। তারা সরবরাহ করলে ১৭৫ টাকায় গায়ের রেট দিয়ে বিক্রি করতে হবে। কিনতে হবে ১৭২ টাকায়। কিন্তু তারা খোলা তেল বিক্রি করে বেশি লাভের আশায় এক লিটারের বোতলজাত তেল সরবরাহ করছে না। আর এখন লিটারপ্রতি কোম্পানিগুলো আমাদের ৩ টাকা লাভ করার সুযোগ দিয়েছে। যা আগে ৪-৫ টাকা ছিল। এতে ভোক্তার সঙ্গে আমাদেরও ঠকাচ্ছে।
ঊষার আলো-এসএ