২৬ জুন, ২০০০। দিনটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য বিশেষ কিছু। এই দিনই যে বাংলাদেশের অপেক্ষা ঘুচে গিয়েছিল। টেস্টের কুলীন ফরম্যাটে খেলার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার শেষ ধাপটা পেরিয়ে গিয়েছিল দলটা। আজ সে মাহেন্দ্রক্ষণের রজত জয়ন্তী। তা রাঙাতে বিসিবির সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! নানান কর্মসূচিতে ২৫ বছর আগের সে প্রাপ্তিকে স্মরণ করতে চাইছে দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এই প্রতিষ্ঠানটি।
তবে মাঠের ক্রিকেট কী বলে? ক্রিকেটাররা কি রজতজয়ন্তীটা রাঙাতে পারছেন? পরিস্থিতি কিন্তু তা বলছে না। পুরোনো হিসেব একপাশে রাখুন। বাংলাদেশ এখন মাঠে আছে শ্রীলংকায়। প্রথম টেস্ট ড্রয়ের পর কলম্বোয় দ্বিতীয় টেস্টের লড়াইয়ে আছে দলটা। যদিও পরিস্থিতিটা ভালো নয়, ২৪৭ রানে অলআউট হয়ে বাংলাদেশ বোলিংয়েও আছে বেশ চাপে। এমন পরিস্থিতি অবশ্য বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয় আদৌ। টেস্টে এমন দৃশ্য তো দলটার জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারই!
২৫ বছর, সময়টা কিন্তু কম নয় আদৌ। একটা দেশ গড়ে ফেলার জন্যও সময়টা বেশ বড়, ক্রিকেটীয় মানচিত্র বড় জায়গা করে নেওয়ার জন্য তো সময়টা যথেষ্ট’র চেয়েও বেশি কিছু। উদাহরণ হিসেবে কাছের দেশ আফগানিস্তানই আছে। দেড় দশক আগের আইসিসি ওয়ানডে লিগ খেলা দলটা এখন খেলছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। কিন্তু ২৫ বছর পেরিয়ে টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থানটা কোথায়?
উত্তরটা হলো– বাংলাদেশ এখনও খাবি খাচ্ছে চোরাবালিতেই, পায়ের তলাতে শক্ত মাটিও পায়নি দলটা। টেস্টে দলের পরিসংখ্যানে চোখ রাখা যাক। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত খেলেছে ১৫৩ টেস্টে, সেখানে হেরেছে ১১১ ম্যাচে, ড্র করেছে ১৯ ম্যাচে, জিতেছে বাকি ২৩ ম্যাচ। হ্যাঁ ২৩ ম্যাচই! তার মানে দাঁড়াচ্ছে টেস্ট আঙ্গিনায় বছরপ্রতি একটা করেও জয় নেই, ড্র নেই। এমন পরিসংখ্যান টেস্টের শুরুর দশ বছরে হলে নাহয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু রজতজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এমন পরিসংখ্যান মোটেও কাম্য নয়।
সবশেষ গল টেস্টে মুশফিক ক্যারিয়ারে ষষ্ঠ বারের মতো ৩০০ বল খেলেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি ৩০০ বলের ইনিংস খেলেননি আর কেউ, জাভেদ ওমর ২ বার খেলেছেন। এছাড়া এমন কীর্তি বাংলাদেশি আরও ৭ ক্রিকেটার করেছেন এক বার করে।
লম্বা ইনিংস খেলা টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করার সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত। এখন পর্যন্ত তেমন লম্বা ইনিংস ২৫ বছরে বাংলাদেশের ব্যাটাররা খেলেছেন সব মিলিয়ে মাত্র ১৫ বার! সর্বোচ্চ রানের ইনিংসগুলোর দিকে তাকালেও পরিষ্কার হয়ে যায় বিষয়টা। ট্রিপল সেঞ্চুরি নেই একটিও, ডাবল সেঞ্চুরিও আছে মোটে ৫টি। বড় ইনিংস খেলাটা যে বাংলাদেশের ব্যাটারদের দিয়ে হয় না, তা একেবারে স্পষ্ট।
কেন এমন হয়? সে প্রশ্নের জবাবটাও নাহয় চলমান বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সিরিজ থেকে নেওয়া যাক। ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পারফর্মার এনামুল হক বিজয় চলমান সিরিজে তিন ইনিংসে ব্যাট করেছেন, রান তুলেছেন মোটে ৪, দুই ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি। বিশেষ করে সবশেষ ইনিংসে যেভাবে তিনি ব্যাট করছিলেন, কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠকে মনে হচ্ছিল রীতিমতো মাইনফিল্ড, দুবার ব্যাটের কানায় লেগে ‘জীবন’ পেয়েছেন, দশম বলে বোল্ডই হয়েছেন।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পারফর্মারই যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যর্থ হবেন এভাবে, তখন প্রশ্নটা দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর দিকেও যায়। বহু বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেই সেঞ্চুরি চলে আসে, ওভারপ্রতি একটা দুটো বাজে বল আসেই। সেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি পেতে হলে নিদেনপক্ষে ৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতেই হয়। বাজে বলের জন্য অপেক্ষাটা বেশ লম্বা হয়।’
সে সাক্ষাৎকারের প্রায় দুই দশক হতে চললেও দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটটা ওই সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়নের গুরুদায়িত্বটা ছিল বিসিবির। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে যখন দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পারফর্মার খাবি খাবেন, তখন বোঝা যায়, বিসিবি সে দায়িত্বটা পালন করতে ব্যর্থই হয়েছে।
টেস্ট তো বটেই, ক্রিকেটে উন্নতির আরও একটা পূর্বশর্ত একটা প্রকৃত ক্রিকেট সংস্কৃতির উপস্থিতি। যে সংস্কৃতি সার্কিটে থাকা সব ক্রিকেটারকে আর্থিক নিশ্চয়তা দেবে পুঁজিবাদের এই যুগে, চোট পেলে ভালো পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দেবে, তা সেরে ক্রিকেটে ফেরার রাস্তা দেখাবে, পারফর্ম করলে জাতীয় দলের রাডারে চলে আসা যাবে, এমন স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার আশ্বাস দেবে। বহু বছর চলে গেলেও এমন কিছুর উপস্থিতি বাংলাদেশের ক্রিকেটে নেই।
২৬ জুন এলে প্রায়ই দেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির বর্ষপূর্তি নিয়ে ঘটা করে আয়োজন করা হয়। তবে সে দিনটার পর থেকে দেশের ক্রিকেটের অর্জন কী, সে হিসেবের খেরোখাতা খুলে তার ময়নাতদন্তের উদ্যোগটা নেওয়া হয় না। স্ট্যাটার প্রাপ্তির ২৫ বছর পরও তাই টেস্ট ক্রিকেটে দলের পায়ের নিচে শক্ত মাটি নেই, ছুটোছাটা কিছু সাফল্য বাদে বড় কোনো অর্জনও নেই।
ঊষার আলো-এসএ