ঊষার আলো রিপোর্ট :গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মহা-অভ্যুত্থানের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ববাদী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। অভ্যুত্থানকারীদের হাতে শেখ হাসিনার জীবননাশের শঙ্কা থাকায় তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে যান। তাকে ভারতের হিন্দান বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয় বাংলাদেশের একটি সি-১৩০ হারকিউলেস সামরিক বিমান। হিন্দান বিমান ঘাঁটিটি দিল্লির কাছাকাছি একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি। শেখ হাসিনা গর্ব করে বলতেন, শেখ হাসিনা পালায় না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, গণ-অভ্যুত্থানের প্রবল তোড়ে শেখ হাসিনাকে পালাতে হলো। শেখ হাসিনা বলতেন, ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। যে ভারতকে তিনি সাধ্যাতীতভাবে তুষ্ট করতে চেয়েছেন, সেই ভারতেই এখন তার আশ্রয়। সম্ভবত শেষ আশ্রয়। তিব্বত থেকে পালিয়ে আসা ধর্মীয় নেতা দালাইলামা যুগ যুগ ধরে ভারতের আশ্রয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি জীবনসায়াহ্নে উপনীত। তার ভাগ্যে হয়তো আর তিব্বতে ফেরা হবে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের জন্য একটি বড় সুযোগ হলো, প্রায় দেড় মাসের মাথায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার বিরল সুযোগ পেয়েছেন। এসব বৈঠকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বেলা ১১টায় (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাত ৯টা) জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা ও নিউইয়র্কের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দুই নেতার এ বৈঠক ইঙ্গিত করে যে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হতে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে খুবই সমাদৃত একজন ব্যক্তি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২টি সর্বোচ্চ মানের মেডেলে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর কূটনৈতিক পর্যায়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আশা প্রকাশ করছিলেন যে, মার্কিনিরা বাংলাদেশের ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিশাল আকারে সাহায্য-সহায়তা নিয়ে আসবে। এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে মার্কিন সহায়তার বিষয়ে দুই নেতা বিষদ আলোচনা করেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন বাসসকে বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বাংলাদেশের হয়ে কথা বলা একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। গত কয়েক যুগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের কোনো নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। সে বিচারে বাইডেন-ইউনূস বৈঠক বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত।
শেখ হাসিনার শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কে দুঃখজনক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক উক্তি করেছেন। তার দলের নেতারা মার্কিন দূতকে নিয়ে অনেক উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। দিনের পর দিন সাক্ষাৎকার চাওয়া সত্ত্বেও তিনি মার্কিন দূতকে কোনো ধরনের সক্ষাৎ প্রদান করেননি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটের গাড়িতে ইট-পাথর নিক্ষেপ করে তাড়া করেছিল যুবলীগের পাণ্ডারা। এ ঘটনায় মার্সিয়া বার্নিকাটের জীবন বিপন্ন হতে পারত।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এর বাইরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন শীর্ষনেতার সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানদের কোনো বৈঠক হয়নি। ড. ইউনূসের সঙ্গে জো বাইডেনের বৈঠকের তাৎপর্য আলোচনা করতে হলে উল্লেখ করতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছে। এ প্রতিনিধিদল এর আগে দিল্লিতে গিয়েছিল। সেখানে তারা বাংলাদেশকে বিরক্ত না করার জন্য দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের ২ সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈঠক করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের সামনের দিনের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র যেসব ধরনের সহায়তা করবে, সে ব্যাপারে আভাস পাওয়া যায় জো বাইডেন-ইউনূসের পরিকল্পিত বৈঠক থেকে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ড. ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্স শেখ সাবা খালেদ আল-হামাদ আল সাবা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কোফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার গিরবার্ট হাংবো, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে নিউইয়র্ক সফরকালে দেখা করবেন। এসব বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা। জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটসংক্রান্ত একটি পার্শ্ব অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করবেন।
সুনির্দিষ্ট সময়েই জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের। এ পূর্ণ সমর্থনের অর্থ হলো সর্বাত্মক সমর্থন। বৈঠক উপলক্ষ্যে জো বাইডেন ড. ইউনূসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় আলিঙ্গনে মিলিত হন। আলিঙ্গনের নিবিড়তা বলে দেয়, এ দুই রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা কত গভীর। বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তির কাছে এটা একটা বার্তাও বটে।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের জীবন উৎসর্গের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জানান ইউনূস। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। বাইডেন বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যদি দেশের জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেরও আরও বেশি কিছু করা উচিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এবং অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি সংবলিত একটি বই The Art of Triumph বাইডেনের হাতে তুলে দেন ড. ইউনূস। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের বৈঠক হয়নি। ভারত গোড়া থেকেই এ বৈঠক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। হ্যাঁ, একটি বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের মধ্যে। এ বৈঠকে উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আলোচিত হয়। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠক না করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক করে ভারত জানান দিল, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ওয়াটারড্ ডাউন করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়ন চলতে থাকবে। বিজেপি নেতা অমিত শাহ বাংলাদেশিদের উলটো ঝুলিয়ে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কে আরও একটি কাটার ঘা সৃষ্টি হলো। ঢাকা ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনারকে তলব করে এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। বহু বছরের মধ্যে ভারতের অ-বন্ধুসুলভ উক্তির প্রতিবাদ ঢাকার পক্ষ থেকে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ড. ইউনূস। দুদেশের সম্পর্ককে আরও জোরদার করার বিষয়ে তারা আলোচনা করেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ায় ইউনূসের প্রশংসা করেন ট্রুডো। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আরও ভিসা দেওয়ার জন্য কানাডার প্রতি অনুরোধ জ্ঞাপন করেন ড. ইউনূস। তিনি জাস্টিন ট্রুডোর হাতে গণ-অভুত্থানের গ্রাফিতি সংবলিত বইটি তুলে দেন।
দেশে একের পর এক ঝামেলার ঘটনা ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও প্রফেসর ইউনূসের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়া নিয়ে আমার কাছে কোনো কোনো ব্যক্তি তাদের আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু এ কথা তো মানতে হবে, জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সফল বৈঠক করে ড. ইউনূস দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছেন। দুর্জনেরা বলাবলি করছিলেন, ড. ইউনূসের সরকার একটি অবৈধ সরকার এবং অসাংবিধানিক সরকার। কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. ইউনূস যেভাবে বিশ্বনেতাদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছেন, তা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার সরকার জনতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্বপরিসরে স্বীকৃত ও নন্দিত। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। অমিত শাহর আপত্তিকর মন্তব্য সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিতে কুণ্ঠিত নয়। আশা করা যায়, বাংলাদেশের ভেতরে যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, তারা অচিরেই হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবেন। সেনাপ্রধান বলে দিয়েছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। এরপর বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ নেই বললেই চলে।
ঊষার আলো-এসএ