ঊষার আলো ডেস্ক : ‘সমকাল বলতে আমরা যদি বর্তমান শতককে বিবেচনা করি, যার একুশ বছর গত হয়েছে Ñ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু ঘটনা এবং অঘটন ঘটেছে। ২০০০ সাল থেকে ২০০১ এক সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালের শেষে নজিরবিহীন সন্ত্রাস ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধীদের চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এসে যাবতীয় সন্ত্রাস, ভিন্নমত দমন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল তা আমরা জানি। একইভাবে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মহাজোটের সাফল্যও আমরা দেখছি। একটানা বার বছর ক্ষমতায় থাকাকালে বর্তমান সরকার আমাদের দাবি এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভ করেছে। এই সরকারের বিস্ময়কর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেÑ এসবই সত্য। কিন্তু এর চেয়ে কঠিন সত্য হচ্ছে যে আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গিয়েছে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি খুলনা জেলার ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যকালেলেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির একথা বলেন।
সোমবার (২৮জুন) বিকাল সাড়ে ৩টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি খুলনা জেলা শাখার উদ্যোগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনার বিষয় হচ্ছে ঃ ‘সমকালীন রাজনীতি ও জাহানারা ইমামের আন্দোলনে চ্যালেঞ্জ’। ওয়েবিনারে নির্মূল কমিটি খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম-এর সভাপতিত্বে ও নির্মূল কমিটি খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী মহেন্দ্র নাথ সেন সাঞ্চলনায় আলোচক হিসাবে থাকবেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল, নির্মূল কমিটির খুলনা জেলার সহ-সভাপতি সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দী, নির্মূল কমিটি খুলনার সাবেক সদস্য সচিব সাংবাদিক মঞ্জরুল আলম পান্না, জাসদ খুলনা মহানগরের সভাপতি খালিদ হোসেন, ওয়ার্কাস পাটির কেন্দ্রীয় নেতা দিপঙ্কর সাহা দিপু, নির্মূল কমিটির চুকনগর শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ এমবিএম শফিকুল ইসলাম, প্রজন্ম ৭১-এর খুলনার সদস্য মফিদুল ইসলাম টুটুল, খুলনা আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট ফরিদ আহমেদ ও ওয়ার্কাস পাটি খুলনা মহানগরের সভাপতি মফিদুল ইসলামসহ খুলনা জেলার নেতৃবৃন্দ।
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০১৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে বলেছিলাম সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশ এবং বিশ্বের অন্তত একশটি ভাষায় এটি অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। বর্তমানে ধর্মের নামে সমগ্র বিশ্বে সংঘাত, সন্ত্রাস, গৃহযুদ্ধ ও সা¤প্রদায়িক হানাহানি সংঘটিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এই দুঃসময়ে বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রেও নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সরকার কিংবা আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রামাণ্য জীবনী রচনার উদ্যোগও গ্রহণ করে নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমসাময়িক শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রনায়কদের ভেতর বঙ্গবন্ধু বহু ক্ষেত্রে অগ্রগামী হলেও বর্তমান বিশ্বে কোথাও তার জীবন ও দর্শন সেভাবে আলোচনায় আসে না। না আসাটাই স্বাভাবিক, কারণ বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের নেতাকর্মীরা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণের প্রয়োজন বোধ না করেন, সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর চর্চা আশা করা বাতুলতা মাত্র।
‘বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার আদর্শ অনুসরণ না করলেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতারা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না। অথচ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
‘যে বাঙালিত্বের চেতনা বাংলাদেশ সৃষ্টির নিয়ামক ছিল, ’৭৫-এর পর থেকে সে চেতনা মুছে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল পাকিস্তানকামী মৌলবাদী সা¤প্রদায়িক অপশক্তি। হেফাজতে ইসলাম এই অপশক্তিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। হেফাজতকে জামায়াতবিরোধী এমন কি ‘ইসলামপাবন্দ’ মনে করা চরম মতলববাজী ছাড়া আর কিছু নয়। হেফাজতিরা শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ খেতাব দিয়ে নিজেদের মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি ঠিকই আদায় করে নিয়েছে, তাদের পাঠক্রমে সরকারকে বিন্দুমাত্র নাক গলাতে দেয়নি। আমরা শেখ হাসিনাকে মৌলবাদী সন্ত্রাসী কওমি মামুনুলদের জননী হিসেবে দেখতে চাই না। তাকে আমরা ‘মানবতার জননী’ হিসেবে দেখতে চাই; এগার লক্ষ বিপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার পর পশ্চিমের গণমাধ্যম যে বিশেষণে তাকে ভূষিত করেছিল।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারত্ব ও চেতনা। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে অসা¤প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনা। এই চেতনাকে অস্ত্রে পরিণত করেই বঙ্গবন্ধু জিন্নাহ থেকে জেনারেল ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী সা¤প্রদায়িক পাকিস্তানকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত করে, বাংলাদেশের মাটিতে সা¤প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্রের বিজয় পতাকা উড়িয়েছিলেন। ’৭৫-এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার প্রক্রিয়ায় বাঙালীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও অপসৃয়মান। গ্রাম বাংলায় এক সময় বছর জুড়ে মেলা বসত। যাত্রা, পুতুলনাচ, সার্কাস, লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ, নাগরদোলা, গানের আসর, কবির লড়াই এসবের পাশাপাশি গ্রামের কারুশিল্পীরা আসতেন তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে। কত রকমের মিষ্টান্ন বিক্রেতারা আসতেন সপ্তাহ অথবা মাসব্যাপী এসব মেলায়। ওয়াজের মাধ্যমে প্রচারিত এসব ঘৃণা-বিদ্বেষের ভাইরাস করোনাভাইরাসের চেয়ে শতগুণ বেশি বিপজ্জনক। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পায়, মনোজগতে হিংসা ও জিঘাংসার প্রবৃত্তি জাগরিত হয়, ধর্মের নামে ভিন্নধর্ম বা ভিন্নমতের মানুষকে হত্যার পাশাপাশি আত্মহননেও সে দ্বিধাবোধ করে না। তাকে দিয়ে যে কোন সন্ত্রাসী কাজ করিয়ে নেয়া যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, গ্রামে বা মফস্বল শহরে এসব ওয়াজ মাহফিলে অধিকাংশ সময় প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, কখনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও বটে।
নির্মূল কমিটি খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তি ওয়াজ ও দাওয়াতি কার্যক্রমের নামে তৃণমূলে বিস্তার ঘটাচ্ছে। নির্মূল কমিটিকে এই অপশক্তি প্রতিরোধে তৃণমূলে সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদী অপশক্তির অপপ্রচার বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অপশক্তি ‘সাইবার জেহাদ’ মোকাবেলার জন্য নির্মূল কমিটি একটি সাইবার বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশে বিদেশে নির্মূল কমিটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। আগামী সম্মেলনের আগে এই সংখ্যা ১০ লক্ষে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।