UsharAlo logo
শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেরীওয়ালা শহিদের স্বপ্ন মেয়ে ডাক্তার হবে

koushikkln
অক্টোবর ১৭, ২০২২ ১২:২৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

মোঃ আশিকুর রহমান : সল্প বয়সে হারিয়েছি বাবাকে। টাকার অভাবে বাবাকে চিকিৎসা করাতে পারিনি, চোখের সামনে দেখেছি বিনা চিকিৎসায় বাবাকে মারা যেতে। বার বার ডাক্তারের নিকট ছুটে গিয়ে হাত পায়ে ধরেছি আমার বাবাকে একটু সুস্থ করে তুলুন, কোনো কথা তারা কর্ণপাত করেননি। বলছেন তোর বাবাকে চিকিৎসা করাতে গেলে প্রচুর টাকা লাগবে, তা কি তোদের কাছে আছে? কথা গুলো আজকের নয়, এখন হতে প্রায় পনের বছর আগের। তাই সেদিন বাবার হাসপাতালের বারান্দায় বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মৃত্যুটা আজও আমাকে কাদায়। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি রিক্সা চালিয়েও আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে হয়, তবে তাই করবো। মেয়ে ডাক্তার হলে টাকার অভাবে আর কোনো বাবাকে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরে যেতে হবে- এমনই কথা গুলো অশ্রæসিক্ত নয়ণে ১৫ হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা ফেরীওয়ালা মোঃ শহিদুল ইসলাম শহিদ।

মোঃ শহিদুল ইসলাম শহিদ (৩৭)। বাড়ী পাবনা জেলার সদর থানার কুমারপুর গ্রামে। বর্তমান বসবাস খুলনার পাওয়ার হাউজ মোড়ে হান্নানের বাড়ীতে। কয়েকজন মিলে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন, নিজের ভাগে পড়ে সর্বসাকূল্যে পনের শত টাকা। গ্রামের বাড়ীতে বৃদ্ধ মা আছেন, আছেন স্ত্রী, দুই মেয়ে আর ভাই-বোন। সকাল হলেই দু’ হাতে হাওয়াই মিঠার ঝোকা নিয়ে নেমে পড়ে খুলনার স্থানীয় এলাকাগুলোতে। দুপুরের খাবারটা কোনো সেরে নেই বাইরে। বাড়ীতে ফেরেন রাতে, তারপর আবার হওয়াই মিঠা তৈরীর কাজ। এই ব্যবসাটা আদি। তার পূর্ব পুরুষ করে আসছেন, বাবাও করেছেন। বাবার হাত ধরে শেখা এই কাজটি।

শহিদ জানান, বাবা যখন মারা যান আমার বয়স ষোল হতে সতের বছর। আমরা চার ভাই, দুটি বোন। বাবা মারা যাওয়ার পর পাবনাতে গেজ্ঞি তৈরীর কারখানায় কাজ নেয়। সপ্তাহে হাজিরা দিতো দেড়শো টাকা। বড় ভাইরের ঘরে খেতে তাকে সপ্তাহে গুনতে হতো একশো টাকা। তারপর গেজ্ঞির কাজ ছেড়ে শুরু করলেন রিক্সা চালানো। ন্যায্য ভাড়া যাইলেও যাত্রীরা বাবা তুলে গালাগাল করতো। কারণ বিনা ভাড়াতে রিক্সা চড়তে পারলে ভালো হতো, এমন ভদ্র মানুষও সমাজে অহরহ। মরা বাবাাকে তুলে গালমন্দের কারণে শহিদ ছেড়ে দিলেন কাজ। এরপর পাবনাতেই একটি প্লাস্টিক কারখানাতে কাজ নিলেন।

দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর। মা ঘরে তুললেন পুত্রবধু। কাটতে লাগলো সময়। আজ শহিদের দুই মেয়ে। একটি মেয়ের বয়স দেড় বছর অন্যটির তিন। গেল করোনায় প্লাস্টিকের কারখানা বন্দ, বন্দ শহীদের বেতনও, নয় হাজারের উপর বেতন পেতেন তিনি। ফিরে এলেন বাবার আদি পেশায়। তবে মারা মৃত্যুর কারনটা শহিদের বুকে আজও চাপা। বিবাহের আগে হতেই তিনি ব্যাংকে একটি হিসাব খোলেন। এখন প্রতি মাসে মেয়ের নামে ডিপিএস’ এ দু’হাজার করে টাকা সঞ্চয় করেন তিনি। কারন সেভাবে হোক, আর যে করে হোক মেয়েকে ডাক্তার বানাতে হবে। তিনি জানান, আমি চাই না, কোনো সন্তানের সামনে তার বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাক। আমার জীবন যুদ্ধ চলবেই। আল্লাহ আমাকে বাচিয়ে রাখলে আমি আমাকে মেয়ে ডাক্তার বানাবোই ইনশাল্লাহ। প্রয়োজনে মাথা গোজার ঠাই যতটুকু গ্রামের জমি আছে তা বিক্রি করে দেব তবুও মেয়েকে ডাক্তার করে তুলবো।

শহিদ জানান, প্রতিদিন সকালে খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেটে ফেরি করে হাওয়াই মিঠা বিক্রি করি। বিশেষ করে স্কুল কলেজ সম্মুকে ভালো বিক্রি হয়। প্রতি প্যাকেট বিক্রি করি ১০ টাকা, তিন প্যাকেট ২৫ টাকা। দিন শেষে নয়শো’ হতে হাজার টাকা নিয়ে ঘরে ফিরি। আমার রাতে গিয়ে পরবর্তী দিনে জন্য তৈরি করি হাওয়াই মিঠা। হাওয়াই মিঠা তৈরী তিন শুরু চিনি লাগে, লাগে পিপি ও জ্বালানী হিসাবে লাগে স্পীড। কারণ কেরোসিন দিয়ে জ্বাল দিয়ে মিঠাতে তেলের গন্ধ হয়ে যাবে। প্রতি সপ্তাহে পরিবারের খরচের জন্য দু’ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে দেয়। মাকে পাঠায় আলাদা খরচ। নিজে বাড়ীতে যায় দু’ তিনমাস পরপর।

তিনি প্রতিবেদককে জানান, ভাই দোয়া করবেন আমি যেন আমার স্বপ্নপূরন করতে পারি। আমি চাইনা আমার মেয়েও যেন তার বাবাকে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বারান্দায় ধুকে ধুরে মরতে না দেখে। মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হলে বিনা টাকাতে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেবে এটাই কেবল আমার চাওয়া। এ কারণে বর্ষা, রৌদ উপেক্ষা করে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি, অন্য কোনো কারনে নয়। সমাজে এমন গরীব, অসহায় শহীদ মতো অনেক মানুষই আছে, যাদের স্বপ্ন আকাশে ছোয়া! তাদের স্বপ্ন হয়তো পূরণ হবে একদিন! এমনই প্রত্যাশা করেন তারা।