UsharAlo logo
শুক্রবার, ২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘শান্তির পায়রা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

usharalodesk
মে ২৩, ২০২১ ৫:০২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

নাসরীন জাহান লিপি : ‘শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’ শিরোনামে গত ২৪ মার্চ ২০২১ উদযাপিত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ‘মুজিব চিরন্তন’ শীর্ষক মূল প্রতিপাদ্যের দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা’র ৮ম দিন। ‘শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরার এই আয়োজনে সম্মানিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভূটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে আয়োজিত উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং তাঁর বক্তব্যে বললেন, “বিশ্ববাসীকে বলার মতো একটি সুন্দর গল্প বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ”
তিনি আরও বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, অন্যকে বলার মতো একটি গল্প প্রত্যেক মানুষ ও জাতির থাকা উচিত।” কী সৌভাগ্য আমার এবং আমার মতো বাংলাদেশের সব মানুষের! অন্যকে বলার মতো একটি অসাধারণ গল্প আছে আমার, আছে বাংলাদেশের সব মানুষের, বাঙালি জাতির। বিশ্ববাসীকে বলার মতো এই অসাধারণ গল্পটি আমাকে এবং আমাদের সবাইকে উপহার দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য কি? শান্তি, মুক্তি ও মানবতা। পাকিস্তানের দখলদারী মনোভাবের ফলে অশান্তির আগুণে জ¦লতে থাকা এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা এনে দিয়ে কেবল মাত্র বাংলাদেশেই শান্তি আনেননি তিনি, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির বীজ বপন করে গেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন আয়োজনে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে পরিদর্শক বইয়ে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশ ও সারা বিশে^র সব শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে শ্রদ্ধার এই পবিত্র স্থানটি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ ও আলোড়িত করেছে।”
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর তাঁর কাছে বাংলাদেশ ও সারা বিশে^র সব শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পবিত্র স্থান। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য প্রতিটি স্থান আসলে তা-ই। সেই অর্থে বিশ্বের কাছে গোটা বাংলাদেশই আজ পরিণত হয়েছে শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য শ্রদ্ধার পবিত্র স্থান। বাংলাদেশ কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্যই শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে আলোচিত হয়েছে, স্বীকৃত হয়েছে এবং বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবে বলে বিশ্ববাসীর চাওয়া হিসেবে পরিণত হয়েছে।
১৯৭১ সালে লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশে শান্তির পায়রা উড়িয়ে এই বারতা প্রথম দিয়েছেন তো শান্তিপ্রিয় সেই মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্মান। সে-ই প্রথম। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার স্থপতি, গণতন্ত্র ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূষিত হলেন ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে। এই পুরস্কার প্রাপ্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যা তিনি এসে দিতে পেরেছিলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে, যাদের তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন।
১৯৭৩ সালের ২৩ মে। বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির ৪৮তম বার্ষিকী উদ্যাপনের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিনটিকে আনন্দের সাথে উদ্যাপনে জাতির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা মহামারী। রোগ-শোকে কান্ত পৃথিবীতে এখনো চলছে যুদ্ধের হানাহানি। মিয়ানমারে প্রতিদিন রক্ত ঝরছে নিরীহ জনগণের। দখলদার ইজরায়েল প্রতি মিনিটে শত বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কেড়ে নিচ্ছে শিশু-নারীসহ সাধারণ মানুষের প্রাণ। ‘শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’ বঙ্গবন্ধু তাই এখনো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণে এখনো পৃথিবীতে শান্তি অধরা। এই প্রাসঙ্গিকতায় এ বছরের ২৩ মে অনেক বেশি আলোচনার দাবী রাখে।
‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকের সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিখ্যাত দুই পদার্থবিজ্ঞানী মেরি কুরি ও পিয়েওে কুরি’র নাম। বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে এই বিজ্ঞানী দম্পতির অবাদন অনস্বীকার্য। তাঁদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে তাঁদের নামে এই শান্তি পদক প্রবর্তন করে। ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে ও মানবতার কল্যানে শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদান করা হয়। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের হো চি মিন, প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত, চিলির সালভেদর আলেন্দে, দণি আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, চিলির কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, ভারতের জওহরলাল নেহেরু, আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং, রশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্ব নেতাদের এই পদকে ভূষিত করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর তারিখে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ^ শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বিশ্বের ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলন ও বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জোরালো ভূমিকা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুর নাম প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব আলী আকসাদ। বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক ভূষিত করার পেছনে তাঁর আন্তরিক ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হবে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল আগ্রাসী নীতির বিপরীতে বঙ্গবন্ধু সরকার ঘোষণা করেছিলেন জোট নিরপেক্ষ নীতি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারোর সাথে বৈরীতা নয়- এই নীতির মাধ্যমে শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে বঙ্গবন্ধু সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছিল। বিশ্ব শান্তির জন্য এই নীতির গ্রহণযোগ্যতা কতখানি, এর প্রমাণ মিলল ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক অর্জনের মধ্য দিয়ে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি এখনো কী ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক! কোভিড-নাইন্টিন সৃষ্ট মহামারী ঠেকাতে টিকা পেতে হবে পৃথিবীর মানুষকে। সব দেশ এখনো সেই টিকা পায়নি। টিকা-বাণিজ্য, টিকা-রাজনীতির শিকার হচ্ছে ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রের জনগণ। পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি সবার জন্য টিকা সুলভ করতে অর্থ সহযোগিতা করতে পারত, যে আহবান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতাবান পক্ষকে বার বার করেছেন। অথচ বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরিতে ব্যয় করা হচ্ছে অস্ত্র।
ফিরে যাই ১৯৭৩ সালের ২৩ মে তারিখে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশ ছিল সেদিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা জন রিড উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন ভারতের বিখ্যাত শান্তিবাদী নেতা কৃষ্ণ মেনেন। সেই সমাবেশে মহাসচিব ঘোষণা করলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’
কেবলমাত্র বাংলার বন্ধু তিনি নন, বিশ্বেরও বন্ধু বটে। বাংলার শান্তির পায়রা বিশ্বময় শান্তির প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হলেন। রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে ১৯৭৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। আর ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতিসংঘের মাতৃভাষা বাংলায় প্রথম বার ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই ভাষণেও তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছিলেন শান্তির অমোঘ বাণী। বলেছিলেন শান্তির পক্ষে তাঁর বিশ্বাসের কথা- “মানবজাতির অস্তিত্ব রার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তাহা সমগ্র বিশ্বের নরনারীর গভীর আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাইবে। এবং ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রাপ্তির ৪৮তম বার্ষিকীতে শান্তির পক্ষে উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বাস অতি দ্রুত বাস্তবায়িত হোক, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হোক, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : নাসরীন জাহান লিপি, প্রধান মিডিয়া কর্মকর্তা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।

(ঊষার আলো-আরএম)