UsharAlo logo
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সবই করেন শাড়ি পরে

usharalodesk
জুন ৪, ২০২৪ ৫:০৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : জীবনে প্রথম গায়ে জড়িয়েছিলাম আম্মুর বিয়ের শাড়ি। সেই যে শাড়ির প্রেমে মজেছি, তা এখনো চলছে। ক্যাম্পাসের প্রেজেন্টেশন, যেকোনো উৎসব কিংবা এক পশলা বৃষ্টিতে হাঁটতে বেড়ানো—কোনো কিছুতেই শাড়ি গায়ে জড়াতে ভুলি না। দেশে বান্ধবীরা নানা অজুহাতে শাড়িকে পাশ কাটিয়ে যখন অন্য পোশাক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত, আমি তখন দিব্যি শাড়ি পরে নিজেকে সামলে নিতাম।

কেউ কেউ অবাক হতো, কেউ আবার কিঞ্চিৎ বিরক্ত। জাপানে আছি বেশ কয়েক বছর। তবে জাপানি অনেক নারীই শাড়ি চেনে না। পশ্চিমা পোশাকেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজে।

জাপানের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির মিল-অমিল সবই দেখি আমি, শুধু দেখি না শাড়ি। তবে আমার সব কিছুতে শাড়ি চাই। গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই শাড়ি পরে। অনেকে কৌতূহলবশত তাকিয়ে থাকে, অনেকে আবার জানতে চায় শাড়ি সম্পর্কে।

নিজ দেশের ঐতিহ্য একজন ভিনদেশির কাছে উপস্থাপন করার চেয়ে সুখের আর কিছু নেই। জাপানের মানুষজন খুব হালকা রঙের পোশাক পরে। আমরা তুলনামূলক একটু গাঢ় রঙের পোশাকে অভ্যস্ত। উৎসব বা গুরুত্বপূর্ণ দিনে এখানকার মেয়েরা সাধারণত পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরলেও শাড়ি পরিহিতা আমি একটু আলাদাভাবেই সবার নজরে পড়ি।আমার শৈশব কেটেছে কুমিল্লায়।

অন্য সব বাঙালি পরিবারের মতো আমার পরিবারও চায়নি আমাকে দূরে কোথাও পড়াশোনার জন্য পাঠাতে। বুঝতে শেখার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে চারপাশের দেয়ালটা ভাঙাব, হলে থাকব, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে বেড়াব। হলে থাকার ইচ্ছাটা অপূর্ণ রয়ে গেছে। কিছুদিন আত্মীয়র বাসায় থাকার পর মা-বাবাসহ সবাই চলে আসে ঢাকায়। তবে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম দেশের নানা প্রান্তে। নেপালে গিয়েছিলাম একবার, বাঞ্জি জাম্পও করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। স্নাতকোত্তরের পর গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতে জাপানে চলে আসি। আমার গবেষণার বিষয় ‘হাউ মাইগ্রেশন প্লেইস অ্যা ক্যাটালিস্ট টু চেঞ্জ ম্যাসকুলিনিটি কনস্ট্রাকশন’। ২০২১ সালে জাপানের চিবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করি।

শাড়ি পরে যত কাজ করা যায়, প্রায় সবই করেছি জাপানে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর সাইকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা, ঘুরে বেড়ানো, স্নোবোর্ডিং, স্কাইডাইভিং, স্কেটিং। জাপান শীতপ্রধান দেশ। তবে টোকিওতে তুষারপাত হয় না। পাশের শহর আইকামায় বরফ থাকে বছরে প্রায় ৯ মাস। স্কাইডাইভিংয়ের জন্য এটি উত্তম জায়গা। নাগানো ও নিগাতা শহরে করি স্নোবোর্ডিং। স্কেটিং করি মাঝেমধ্যে। টোকিও স্কাইডাইভিং ক্লাব প্রতি সপ্তাহে স্কাইডাইভিংয়ের আয়োজন করে। প্রতিটি খেলার একটি নির্দিষ্ট পোশাক থাকে। জাপান দেশ হিসেবে প্রচণ্ড সচেতন। ১ শতাংশ অসাবধানতাকেও তারা গ্রাহ্য করে না। তার পরও আমার শাড়ি পরা নিয়ে কোনো স্পোর্টস ট্রেইনার বাধা দেননি। তবে সাবধানতার জন্য শাড়ি পরার ধরন বদলাতে হয়েছে। বাঁধতে হয়েছে শাড়ির আঁচল। প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়েছি। ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর হলেও চাই না কোনো মেয়ে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এতটা ঝুঁকি নিক। স্নোবোর্ডিংয়ের সময় অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় পুরো শরীর অসাড় হয়ে যায়। এ জন্য নিজেকে উষ্ণ রাখতে তাপ প্রতিরোধী টি-শার্টসহ শাড়ি পরি। পেটিকোটের জায়গায় থাকে স্নোবোর্ডিং প্যান্ট। শাড়ি পরার ধরন থাকে দক্ষিণ ভারতীয় পুরুষদের ধুতির মতো আর নিরাপত্তার জন্য আঁচল বাঁধা থাকে বেল্টের সঙ্গে। উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন পোশাক শাড়ি। বাঙালি নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে শাড়িতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে এখন মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ বা পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত হচ্ছে। অনেকে আবার শাড়িকে নারীর পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছে। আমি শুধু এই ট্যাবুটা ভাঙতে চেয়েছিলাম—কোনো পোশাকই মেয়েদের পিছিয়ে রাখে না।

শাড়ি পরে লাফ দেওয়া বা কোনো খেলায়ই এখন পর্যন্ত সমস্যা হয়নি। তবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্কুলে স্পোর্টস ক্লাব নেই। ফলে আমাদের স্ট্যামিনা থাকে কম। এসব কারণে প্রথম দিকে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শুরুর দিকে স্নোবোর্ডিংয়ে অন্য সবার সঙ্গে পেরে উঠতাম না। মাউন্ট ফুজি হাইকের সময়েও গ্রুপে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম। দলের সবার চেয়ে আমার স্ট্যামিনা ছিল কম। ২৮ বছর বয়সে প্রথম স্কেটবোর্ড শুরু করি। প্রথম দিন ডান হাতে আঘাত পেয়েছিলাম। সব সময়েই পরে যাওয়ার একটা ভয় কাজ করত।

জাপানে এসব খেলা নিয়ে নানা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সব ধরনের খেলাধুলা শখের বশে করি বলে এখনো কোনো প্রতিযোগিতায় নাম লেখাইনি। তবে বয়স বত্রিশের কোঠায় আসার পর মনে হচ্ছে আরো নতুন নতুন খেলা শুরু করি। বিগত টোকিও অলিম্পিকে সার্ফিংয়ে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছি। আগামী গ্রীষ্মে সার্ফিং শুরু করার ইচ্ছা আছে।

ঊষার আলো-এসএ