UsharAlo logo
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারাতে বসেছে মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প

usharalodesk
মে ২৭, ২০২১ ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট : মেহেরপুরে হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প। এক সময় গ্রামের গৃহস্থলীর কাজে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি, টুকা, শরপস, খাঁচাসহ বিভিন্ন পণ্যের বেশ চাহিদা থাকলেও এখন আর খুব একটা চাহিদা নেই। দিন-দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি ও আধুনিক জীবনধারায় কমেছে বাঁশ শিল্পের ব্যবহার। ক্ষুদ্র বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া আদি পেশা বদল করে হয়েছেন ভ্যান চালক। কেউ-কেউ আবার জড়িয়েছেন কৃষিসহ অন্যান্য কাজে।
যারা এখনও বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন তাদের সংসার চলছে খুড়িয়ে। অন্যান্য বছরে আম মৌসুমে বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করার তোড়জোড় লেগে থাকে কুঁঠির শিপপাড়াই। কিন্তু এ বছর তেমন কোন তোড়জোড় নেই। প্লাস্টিকের ক্যারেটে আম সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দাস পাড়ায়। একদিকে যেমন কাজ কম অন্যদিকে করোনার থাবা। সবমিলিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এ পল্লীর মানুষ।
সদর উপজেলার আমদহ ইউনিয়নের বামনপাড়া গ্রাম। এখানেই বসবাস করছে দাস সম্প্রদায়ের ৭০টি পরিবারের ২৬০জন মানুষ। স্থানটি দাসপাড়া বা মুচিপাড়া হিসেবে পরিচিত। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের চলতে হয় বিধাতার উপর ভরসা করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় শতবছর ধরে এখানে দাসদের বসবাস। পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, জগন্নাথপুর, মেহেরপুরের শিবপুর, ভবানন্দপুর, গাড়াডোব থেকে উঠে এসে জীবিকার তাগিদে এখানে বসতি গড়ে তোলে। প্রথম দিকে ১০/১২টি পরিবার থাকলেও বর্তমানে পরিবার সংখ্যা ৭০টি। দাস সম্প্রদায় তিন ভাগে বিভক্ত যেমন ঋষি সম্প্রদায়, রুহি সম্প্রদায় এবং কৈবর্ত সম্প্রদায়। তবে এখানে সবাই ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ। দাসপাড়ার ৭০ পরিবারের মোট জমির পরিমাণ ৪ বিঘা মতো হবে। বেশিরভাগ পরিবারেরই এক কাঠা করে জমি, কয়েকজনের আছে ৩ কাঠা এবং একমাত্র মকুল চন্দ্র দাসের আছে ৫ কাঠা জমি। মাঠে চাষের জমি ১ জনেরও নাই। প্রত্যেকের বসবাসের ঘরগুলো চাটায়ের বেড়ার উপরে টিন, কারো বা আঁধাপাকা ইটের গাঁথুনির উপরে টিন।
এদের প্রধান পেশা ক্ষুদ্র বাঁশ-শিল্প। বাঁশের তৈরি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ভাষায় ঝুড়ি, টুকা, শরপস বা খাচি, চাটায়, হাস মুরগী রাখার জন্য এক ধরনের টাপা/ঝুড়ি, আম মৌশুমে আম বহন করার জন্য বিশেষ ঝুড়িসহ নানান সৌখিন সামগ্রী। পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির বউ, লেখাপড়া করা সন্তানেরাও এই কাজে সাহায্য করে থাকে। ৫০ থেকে ৪০০ টাকা দামের ঝুড়ি এখানে তৈরি হয়। কেউ-কেউ অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য ভ্যান চালায়। আধুনিকতার সাথে তাল রেখে আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে কুলা, ঝুড়িসহ বাঁশের তৈরি অনান্য সামগ্রীর ব্যবহার। প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে একমাত্র বাঁশের কাজ জানা এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো বেশ অর্থ কষ্টে ভুগছে। অর্থ কষ্টের কারণে বিভিন্ন সময় কেউ-কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করেছে। কেউ-কেউ একটু উন্নত জীবনের আশায় ভারতেও পাড়ি জমিয়েছে।

লক্ষণ দাস বলেন, আমার এক ছেলে এক মেয়ে। একজন ৮ম ও একজন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। আমি বাঁশের কাজের পাশাপাশি ভ্যান চালাই। সবমিলিয়ে ৭-৮ হাজার টাকা মাসে আয় হয়। কোন রকমে বেঁচে আছি মাত্র। বর্তমান যুগে ৭-৮ হাজার টাকায় কি হয়?
দাসপাড়ার গোষ্ঠী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে মাধব চন্দ্র দাস। নিজেদের মধ্যে বিচার শালিসসহ শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্যে নিজেদের তৈরি কিছু আইন-কানুন বিধি-নিষেধ আছে যা এখানে সকলেই মেনে চলে। তিনি বলেন, আমরা গরীব, ভগবানের কাছে আমরা সবসময় প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ভালো রাখেন। আমরা নিচু শ্রেণী হলেও ভগবান আমাদের সাথে আছেন। সময়ের বিবর্তনে আমরা সমাজে আমাদের পণ্যের চাহিদা কমেছে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন নিয়ে কারিগররা বাঁশ সংগ্রহ করে। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি না হলেও সময় মত লোন পরিশোধ করতে হয়। এতে অনেক সময় এনজিও কর্মিদের কাছে লাঞ্ছিতও হতে হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোশকতা থাকলে হয়তো আমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবো।
স্থানীয় ইউপি সদস্য দরুদ আলী বলেন, এদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় লাগায়, এরা মানুষ হিসেবে ভালো, কারো সাথে কোনও বিরোধে জড়ায় না। ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পের অধীনে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তেতুল দাস ও পারুল দাসকে ঘর করে দেয়া হয়েছে। আরও ১০টা পরিবারকে ঘর দেয়া হবে, অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

আমদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনারুল ইসলাম জানান, বামনপাড়ার দাস পল্লিতে বসবাসরত সদস্যরা অন্যান্যদের মত বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধাব ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্দীরের পাকাকরণের ভিত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেয়া হয়েছে। যেহেতু বাঁশ শিল্প ক্ষুদ্র কুটির শিল্প। ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

(ঊষার আলো-এমএনএস)