ঊষার আলো রিপোর্ট : দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে প্রায় ৫ বছর ধরে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। শুরুতেই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি (বর্তমানে অবসরে) মো. ইমান আলীর নেতৃত্বে এই কমিটি হয়। কিন্তু এরপর ৫ বছর কেটে গেলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও আসেনি। তারা দোষী না নির্দোষ এখনও তা নির্ধারণ হয়নি।
বিচারপতিরা হলেন-বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হক। তবে বিচারকাজে না থেকেও তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করছেন। তারা বিচারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুদিন ছুটিতে ছিলেন। পরে আর ছুটি নেননি। মাঝেমধ্যে সুপ্রিমকোর্টে তাদের জন্য নির্ধারিত অফিস কক্ষে আসেন এবং কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যান। এই তিনজনের মধ্যে এক বিচারপতি অবসরে যাচ্ছেন ডিসেম্বরে। অন্য দুজনের একজন আগামী বছরের নভেম্বরে, অপরজন অবসরে যাবেন ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে। বিচারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগে তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার ৫ বছর হলো। তারা দোষী না নির্দোষ সেটা জানার অধিকার তাদের আছে। এভাবে একটা দুর্নীতির ঘটনা অমীমাংসিত অবস্থায় রাখা অবিচারের শামিল। যা বিচার বিভাগের জন্য দুঃখজনক ঘটনা বলে মনে করেন তারা।
২০১৯ সালের ১৬ মে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিম্ন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পালটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহুরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৩৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল এমআর ট্রেডিং। ঋণখেলাপি হওয়ায় ন্যাশনাল ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে এমআর ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। সে মামলার কার্যক্রম চালু থাকার সময় দুপক্ষের মধ্যে আপসনামা হয় এবং সে অনুসারে টাকা নেওয়ার কথা। এরপর তারা ওই আপসনামা অর্থঋণ আদালতে দাখিল করে সে অনুযায়ী ডিক্রি চান। কিন্তু অর্থঋণ আদালত সে আপসনামার ভিত্তিতে ডিক্রি জারি করেননি। এরপর এমআর ট্রেডিং হাইকোর্টে আবেদন জানায়। সে আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহুরুল হকের বেঞ্চ রুল জারি করেন এবং আপসনামার ভিত্তিতে অর্থঋণ আদালতকে ডিক্রি জারির নির্দেশ দেন।
এরপর পুনরায় অর্থঋণ আদালত ডিক্রি দেন এবং এমআর ট্রেডিং হাইকোর্ট থেকে জারি করা রুল উইথ্রড করে নেয়। পরে ন্যাশনাল ব্যাংক আপিল বিভাগে আসে।
সূত্রমতে, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণসংক্রান্ত এক রিট মামলায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি জারির মাধ্যমে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ রায় পালটে দেন বলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ তুলেছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ সংশ্লিষ্ট অর্থ ঋণ আদালতের (নিু আদালত) মামলাটির সব ডিক্রি ও আদেশ বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এক কর্মকর্তা শনিবার বলেন, তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। মূলত কোন আইনে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করা হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি হলেই তিন বিচারপতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে, না সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে-এ বিষয়টির এখনও সুরাহা হয়নি।
তবে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি শনিবার বলেন, ২০১৭ সালের ৩ জুলাই বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ রায় দেন। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। সেই আইনেই বিচারপতিদের দুর্নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
তিনি বলেন, তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা অনাকাক্সিক্ষত। অভিযোগ থাকলে তাদের বিচার করতে হবে। গত সরকারের একটা বড় সমস্যা ছিল ‘ইগো’ (অহংবোধ)। তারা (সরকার) সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল মানে না, অথচ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনও বিদ্যমান। তিনি বলেন, আগের আইনমন্ত্রী (আনিসুল হক) ইচ্ছা করে আইন পরিপন্থি কাজ করেছেন। পকেটে যেভাবে মানিব্যাগ ব্যবহার করা হয়, ঠিক সেভাবেই তিনি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছেন। মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, তারা (তিন বিচারপতি) দোষী নাও হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। তিন বিচারপতি যদি বিচার না পান, তাহলে দেশে যে আইনের শাসন ছিল, কিভাবে বুঝব প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে কি দুর্নীতির অভিযোগ ছিল সেটি মানুষ জানতে চায়। তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হলো এখনও দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ হলো না যা দুঃখজনক।
সূত্র জানায়, বিধি অনুযায়ী এই বিচারপতিদের জন্য ২৭ জন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। অবশ্য তাদের মধ্যে কয়েকজনকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তিন বিচারপতির বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের জন্য গত ৫ বছরে রাষ্ট্রের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির ৯৫ হাজার টাকা মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতাসহ সর্বমোট প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে অবারিত চিকিৎসা ভাতা, টেলিফোন বিলসহ আরও কিছু সুবিধা পান। এছাড়া একজন বিচারপতির সঙ্গে জনবল সুবিধা থাকে।
ঊষার আলো-এসএ