ফুলবাড়ীগেট প্রতিনিধি : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করলেও বাস্তবে তা কার্যকরী হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে জানা যায়, এ ক্ষেত্রে খুলনার সরকারী ল্যাবরেটরী স্কুল ও কেডিএ সরকারী স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষকরা সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কোচিং বাণিজ্য আরও জোরদার ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এটি বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যেখানে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বাণিজ্য এর সাথে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন যা পরিবারের উপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকগণ হিমশিম খাচ্ছেন। এ ছাড়াও অনেক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিং এ বেশী সময় ব্যয় করছেন। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকগণ চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কেডিএ স্কুলে ক্লাস শুরুর পূর্বে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং করাচ্ছেন। এমনকি ক্লাসে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধকরে কোচিং এ বাধ্য করছেন।
এ ব্যপারে একাধিক শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, সরকারী নিয়ম নীতি মালার মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কোচিং করাচ্ছেন। কেডিএ স্কুলের শিক্ষক জাহিদুল শেখ বলেন শুধু তিনি একা পড়ান না স্কুলের অন্য সব শিক্ষকরা বিশেষ কোচিং করান। এ ব্যাপারে তাদের স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া আছে। এদিকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরাইয়া জাহান স্কুলের পাশেই আবাসিক এলাকাতে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান অভিবাভকবৃন্দ।
জানতে চাইলে শিক্ষক সুরাইয়া জাহান বলেন, আমার বাড়িতে কোচিং হয় এটা সত্য কিন্তু আমি এটা চালাই না, আমার স্বামি ও তার বন্ধুরা মিলে খুলনার বিভিন্ন স্থানে কোচিং সেন্টার খুলেছেন তার একটি শাখা আমার বাড়িতে চলে। কেডিএ প্রধান শিক্ষক মোঃ মাহাবুর রহমান এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার অনুমতি দেয়া আছে। তবে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার কথা আমার জানা নেই। কেডিএর শিক্ষক সুরাইয়া জাহান বাড়িতে কোচিং করাচ্ছেন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন বিষয়টি আমিও একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুুক একাধিক ছাত্রছাত্রীরা অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার কথা স্বীকার করলেও বিভিন্ন কারনে তারা ভীত। ফলে মুখ খুলে কিছু বলতে চান না। এ ভাবেই খুলনা সরকারী ল্যাবরেটরী ও কেডিএ স্কুলের অনেক শিক্ষক সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে পর্দার আড়ালে থেকে তাদের এ বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সচেতন অভিবাভক বৃন্দ অবিলম্বে কোচিং বানিজ্য বন্ধে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কোচিং এ আসা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী জানায়, বিদ্যালয়ের ক্লাসে তেমন লেখাপড়া না হওয়ার কারণে কোচিং করছেন তারা। আবার অনেকে বলছে বিদ্যালয়ে নির্ধারিত ক্লাসে বুঝে ওঠার আগেই ঘণ্টা বেজে যায়। শিক্ষকরা না বুঝানোর কারণে কোচিং এ এসে তারা সেই শিক্ষকের কাছেই পুনরায় বেশি করে তা বুঝে নেয়।
কেডিএ স্কুলে কোচিং করতে আসা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী জানায়, স্কুল চলাকালীন ক্লাসে স্যাররা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কম সময় ক্লাস করান। অল্পসময়ে ক্লাস হওয়ার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কথা বা পড়া তেমন বুঝে উঠতে পারে না। নির্ধারিত সময় পার হতে না হতেই ঘণ্টা পড়ে যায় এবং পরবর্তী অন্য বিষয়ের ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু কোচিং ক্লাসে স্যারেরা আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত ক্লাস নেন এবং ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন।
সরকারী ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায় স্কুলের তুলনায় কোচিংয়ে ভালো লেখাপড়া হয়। স্কুলে ভালো লেখাপড়া হয় না। এ ছাড়া বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা সময়ের অভাবে সেভাবে ক্লাস নিতে পারে না, তবে কোচিং এ অনেক সময় দেন শিক্ষকরা। কোচিং এর জন্য স্যাররা প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসে ১২০০ টাকা নেন।সরকারি বিদ্যালয়ের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কোচিং করানোর দৃশ্য দেখা গেলেও এ বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।
কেডিএ স্কুলের শিক্ষক জাহিদুল শেখ বলেন, তারা বিদ্যালয়ের ভিতরে অতিরিক্ত ক্লাস করাচ্ছেন। ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়া। একই অবস্থা সরকারী ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের। সেখানেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং ব্যবসা চালাচ্ছেন বেশির ভাগ শিক্ষক। শিউলি থান্ডার, নব কুমার মন্ডল, অরবিন্দু হালদার, জাকির হোসেন উল্লেখযোগ্য।
শিউলি থান্ডার ও নব কুমার মন্ডল , স্বামী স্ত্রী। আনুমানিক ১২ বছর যাবত ল্যাবরেটরি স্কুলে আছেন। শিউলি থান্ডার ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর গণিত ক্লাস নেন। তিনি স্কুলের ক্লাসে কোন অংক করান না। কিন্তু কোচিংয়ে অংক করান। আবার যারা তার কোচিংয়ে না পড়ে, তার নিয়মে অংক না করলে তিনি খারাপ আচরন করেন। শিক্ষার্থীদের তার কাছে পড়তে বাধ্য করেন।চতুর্থ পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং ফি বাবদ এক হাজার টাকা করে নেন। পরবর্তী ক্লাস গুলোতে আরো বেশি কোচিং ফি দিতে হয়।
তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুর্গেশ কুমার হালদার জানান, এ বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে নিয়ম না মেনে কেউ কোচিং করালে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবিভাবক জানান, স্কুলগুলোতে লেখাপড়া তেমন হচ্ছে না, শিক্ষকরাও ঠিকমতো মনোযোগ সহকারে বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছেন না। শিক্ষকরা নিজেরাই ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিংমুখী করে তুলছেন। স্কুলের ক্লাস শিক্ষকের কাছে কোচিং না করালে পরীক্ষার ফলাফলে বাচ্চাদের নম্বর কম দেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই বেশির ভাগ অবিভাবক তাদের সন্তানদের কোচিং এ পড়াচ্ছেন। সরকারি স্কুলে চাকরি করা বেশির ভাগ শিক্ষক এখন কোচিং ব্যবসা খুলে বসেছেন। যেখানে সরকারি বেতন বাদ দিয়েও শিক্ষকরা প্রতিমাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন। এ বিষয়ে কোনো অবিভাবক প্রতিবাদ করলে তাদের সন্তানদের ভিন্ন চোখে দেখেন শিক্ষকরা।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন জানান, যদি কেউ সরকারি স্কুলে অতিরক্ত ক্লাসের নামে কোচিং চালান সেটা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে যদি কোন অভিযোগ পাওয়া যায় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন কোন শিক্ষক দির্ঘদিন ধরে একই স্কুলে থাকার নিয়ম নেই, তবে এটা আমার দেখার বিষয় নয় ।