ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাটের কারণে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের আগ্রাসী থাবায় ৫টি বড় ব্যাংক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি আটকে রয়েছে ওই ৫ ব্যাংকের কাছে। এতে ওইসব ব্যাংকের মূলধন ও আয় কমে গেছে। প্রভিশন ঘাটতি ও খারাপ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে সংকট আরও বাড়বে।
রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
প্রতি তিন মাস পর পর এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। তবে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকনীতি সহায়তা বাড়িয়ে আর্থিক দুর্বলতা কাটাতে সহায়তা করছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি বা প্রায় ৫১ শতাংশ। দেশের মোট ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে বাকি ৫৬টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের কম বা ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে খেলাপি ঋণের শীর্ষে ১০ ব্যাংকে রয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৭১ শতাংশ। বাকি ৫১টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ২৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণে শীর্ষ ব্যাংকগুলোতেও এর পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। আগে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে মোট খেলাপির ৩৫ শতাংশ ছিল। এখন তা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে চারটি রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও একটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক।
গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ আরও বেড়েছে।
সাধারণত ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বর্তমানে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের প্রতিটিতে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ১৪টি ব্যাংকে। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮২ শতাংশই আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হয়েছে। ফলে এসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও কম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক দখল করে ব্যাপক লুটপাটের কারণে ওইসব ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। যে কারণে লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বেপরোয়া গতিতে। এর প্রভাবে ব্যাংক খাতে সম্পদের গুণগত মান ও আয় কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি। যা সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
আগে আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণ ও দুর্বলতাগুলোকে আড়াল করে রাখা হতো। যে কারণে বাস্তব চিত্র প্রকাশিত হয়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা প্রকাশ পেতে শুরু করে। যে কারণে এখন প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
ব্যাংকগুলোর বড় গ্রাহকরা খেলাপি হয়ে পড়ায় ও লুটপাটের ঋণ সরাসরি খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করায় এর পরিমাণ বেশি মাত্রায় বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেশি বাড়লে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণে খেলাপি ঋণ যথাসম্ভব কম দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। যাতে খেলাপির হার কমে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কারণে ব্যাংকের বড় গ্রাহকরা খেলাপি হলে এর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। তখন মূলধন ঘাটতিও বেড়ে ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সংকট আরও বেড়ে যাবে।
এদিকে সম্পদের গুণগত মান কমার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত হারে এ সম্পদ বাড়ায় এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন খাতে ঘাটতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
মোট সম্পদের ৩১ শতাংশ শীর্ষ ৫ ব্যাংকের হাতে রয়েছে। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৪৬ শতাংশ সম্পদ। অর্থাৎ শীর্ষ ৫ ও ১০ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত বাড়লেও তাদের সম্পদ বাড়েনি। বরং খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে গেছে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঊষার আলো-এসএ