ঊষার আলো রিপোর্ট : কিশোরগঞ্জ সদরের পশ্চিম তারাপাশা গ্রামের বাসিন্দা দুলাল রবি দাশ ২৭ জুলাই নিজ বাড়িতে স্ট্রোক করে মারা যান। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মৃত্যুসনদেও স্ট্রোকজনিত কারণে মৃত্যুর কথা উল্লেখ আছে। অথচ দুলাল রবি দাশকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন উল্লেখ করে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে।
এ মামলাটির বিষয়ে কিছুই জানতেন না দুলাল রবির স্বজনরা। রাফিউল আলম নামের এক ব্যক্তি নিজেকে আত্মীয় দাবি করে ২৯ নভেম্বর মামলাটি করেন। মামলা নম্বর ৪৩। আসামি করা হয়েছে ১৬৩ জনকে।
এদিকে মামলাটির বাদী ও আইনজীবী আসামিদের থেকে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে নিয়ে মামলা থেকে নাম কাটানোর রমরমা ব্যবসা শুরু করেছেন। এ টাকা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে দিতে হবে বলেও দাবি করছেন তারা। ভুক্তভোগী আসামিদের বেশির ভাগই কৃষক ও দিনমজুর।
যে মামলা নিয়ে বাণিজ্য চলছে, সেটি মিথ্যা দাবি করে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুলালের ছেলে বিকাশ দাশ কিশোরগঞ্জ জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২ ডিসেম্বর অভিযোগ করেন। সেখানে উল্লেখ করেছেন, ‘২৭ জুলাই বিকাল ৩টার দিকে আমার বাবা (দুলাল রবি দাশ) হঠাৎ স্ট্রোক করলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এ সংক্রান্তে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মৃত্যুসনদপত্র রয়েছে। কিন্তু কোনো এক অপরিচিত ব্যক্তি বাদী হয়ে কিছু দুষ্কৃতকারী আমাদের না জানিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মানুষকে হয়রানি করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় আমার বাবার স্ট্রোকজনিত মৃত্যুকে হত্যা মামলা সাজিয়ে রুজু করে। এসব দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
একই মামলায় আরও বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট রুবেল আব্দুল্লাহ নামের এক যুবক আন্দোলনে অংশ নিলে শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল লেগে ঘটনাস্থলেই মারা যান। মামলায় রুবেলের বিষয়ে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র এবং বিভিন্ন স্তরের জনগণ সরকার পতনের একদফা দাবিতে কিশোরগঞ্জ মডেল থানাধীন গুরুদয়াল কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে একটি মিছিল নিয়ে কালীবাড়ি মোড়ে উপস্থিত হলে আসামিরা ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এ সময় রুবেল আব্দুল্লাহ নামের এক যুবকের শরীরে শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল লেগে ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
অথচ কিশোরগঞ্জ শহিদ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া মৃত্যুসনদে বলা হয়েছে রুবেল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ঘটনায়ও রুবেলের বাবা আজহারুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ জেলা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত আবেদন করে বলেছেন, অপরিচিত ব্যক্তি বাদী হয়ে কিছু দুষ্কৃতকারীকে সঙ্গে নিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হয়রানিমূলক মামলা করেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা উল্লেখ করেও আদালতের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানায় ৬ নভেম্বর আরও একটি সিআর মামলা রেকর্ড হয়। বারকের মিয়া নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলা নম্বর ৫। এ মামলায়ও অনেক নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে শুধু মামলা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। এমন মিথ্যা মামলার অনেক নজির রয়েছে কিশোরগঞ্জে। নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাধারণ কৃষকও আছেন। দরিদ্র এসব মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মামলা থেকে নাম কাটানোর রমরমা বাণিজ্যও চলছে। অভিযোগ রয়েছে, এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছেন শওকত কবীর খোকন নামের স্থানীয় এক আইনজীবী। তার সঙ্গে পূর্ববিরোধ রয়েছে-এমন অনেককেই পরিকল্পিতভাবে মামলার আসামি করা হয়েছে।
একটি মামলার বাদীর সঙ্গে এক আসামির স্বজনের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের সূত্রে জানা যায়, বাদী ১৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করলেও আইনজীবী খোকন আরও ৩৩ জনের নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অডিও রেকর্ডটি যুগান্তেরের এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
হয়রানিমূলক একটি মামলার আসামি কৃষক আব্দুল হান্নান। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানায়। অথচ বাজিতপুর থানার এক মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। হান্নান বলেন, ‘আমার ফুপুর সঙ্গে একটি জমির রেকর্ড সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। ওই জমিসংক্রান্ত মামলার উকিল ছিল শওকত কবীর খোকন। বছর চারেক আগে জমি নিয়ে একটি পারিবারিক বৈঠকও বসে। সেখানে খোকন উকিলের সঙ্গে ঝগড়া লাগে আমাদের। একপর্যায়ে সে বাড়ি থেকে চলে যায়। সেই ক্ষোভ থেকেই আমাকে আসামি করেছে।’
হাবিবুর রহমান নয়ন নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার চাচার একটি জমি নিয়ে ঝামেলা ছিল। সেই জমির বিরোধের দরবার (মীমাংসার বৈঠক) বসে। সেখানে শওকত কবীর খোকন ছিলেন। দরবারকে কেন্দ্র করে আমার সঙ্গে বিরোধ বাধে খোকনের। এর জেরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাজিতপুর থানায় একটি ও কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় দুটি হত্যা মামলার আসামি করেছে আমাকে।’
আরেক ভুক্তভোগী করিমগঞ্জের খায়রুল। তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ভাই কবির বিএনপির রাজনীতি করে। তার সঙ্গে খোকন উকিলের ভাই যুবলীগ নেতা রিপনের বিরোধ ছিল। সেই সূত্রে আমাকে দুটি হত্যা মামলার আসামি করেছে।’
কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় হত্যা মামলার বাদী রাফিউল আলমের সঙ্গে এক আসামির স্বজনের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডে বাদীকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি ১৩০ জন আসামির নাম দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আরও ৩৩ জনের নাম যুক্ত করে মামলা করা হয়েছে। অতিরিক্ত নাম মালায় ঢুকিয়েছে উকিল (খোকন)।’
কথোপকথনের একপর্যায়ে বাদী আসামির ওই স্বজনকে বলেন, ‘জনপ্রতি ৫০ হাজার করে টাকা নিয়ে মামলা থেকে নাম কাটা হচ্ছে। বিষয়টি আপনি যেমন গোপনীয়তার সঙ্গে রাখবেন, আমিও রাখব এবং কাজ হবে হানড্রেড পার্সন।’
অ্যাডভোকেট খোকনের টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ওই বাদীকে বলতে শোনা গেছে, ‘সে (খোকন) আমারই নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাডভোকেট। আমার সিগনেচার ছাড়া কিছু হবে না। তাকে কোনো টাকা দেবেন না।’
ভুয়া মামলা করা এবং টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাদী রাফিউল আলম শুক্রবার বিকালে যুগন্তরকে বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি। এখন কথা বলতে পারছি না।’
এদিকে অ্যাডভোকেট খোকনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার বাড়ি করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের নানশ্রী গ্রামে। তার ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান রিপন উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি। নিজ গ্রামের মানুষের একটু ঝামেলাপূর্ণ জমি থাকলেই জোর করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন খোকন। বাধা দিলেই মিথ্যা মামলায় জেল খাটানো তার পুরোনো অপকৌশল। তার এসব অপকর্মের কারণে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিট থেকে অব্যাহতি দিতে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট শওকত কবীর খোকন মঙ্গলবার বলেন, ‘কারও সঙ্গে আমার জমিজমার বিরোধ নেই। আমি কোনো মামলার বাদী না। আমি কোনো ফাইলিং ল’ইয়ার না। কোনো মামলা আমি লেখিনি। কোনো মামলা সম্পর্কে আমি জানি না। এ বিষয়ে আরও কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করেছেন। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার পেশাগত ও পারিবারিক সুনাম নষ্ট করতে এসব অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে।’
ঊষার আলো-এসএ