UsharAlo logo
বুধবার, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আসিফ নজরুল কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন, প্রশ্ন ফরহাদ মজহারের

ঊষার আলো ডেস্ক
অক্টোবর ২৮, ২০২৪ ৩:৩৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সম্প্রতি প্রশ্ন ওঠে এই সরকার কি সাংবিধানিক পথে থাকবে নাকি বিপ্লবী বা জাতীয় সরকার গঠন করবে?

দেশের বৃহত্তম দল বিএনপির সঙ্গে সম্প্রতি সমন্বয়করা বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকের পর গতকাল রোববার (২৭ অক্টোবর) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, সংবিধান মেনেই বিএনপি সবকিছু করার পক্ষে।

সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সম্প্রতি ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, “সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে সেটা এই আন্দোলনে থাকা সবার ভুল”। কিন্তু সরকার গঠনের সময়ে বিপ্লবী সরকার কেন গঠন করা হয়নি এ নিয়েও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন।

পাশাপাশি তিনি প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি ফরহাদ মজহার এক পোস্ট দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন।

ফরহাদ মজহারের পোস্টটি তুলে ধরা হলো।

১. আসিফ নজরুল দাবি করেছেন, “সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে সেটা এই আন্দোলনে থাকা সবার ভুল”। না, মোটেও না। সেটা সবার ভুল হতে পারে না। সেটা একান্তই আসিফ নজরুলের ভুল, কিম্বা রাজনৈতিক দল ও সেনাপ্রধানসহ যারা গণঅভ্যুত্থানকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ঢুকিয়েছে তাদের সকলেরই ভুল।

২. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরাও উপস্থিত ছিলেন উল্লেখ করে, আসিফ নজরুল দাবি করেছেন, ‘পুরো আলোচনা প্রক্রিয়ায় কেউ তো তখন বলেন নাই যে আমরা কেন শপথ নেব, সাংবিধানিক পথে যাব, চলেন বিপ্লবী সরকার গঠন করি?’।

যদি তাই হয় তাহলে আসিফ নজরুল সেই ক্ষেত্রে চুপ করে ছিলেন কেন? কেন বলেন নি এটা ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠনের মামলা নয় একদমই, এটা হচ্ছে গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শহিদদের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা (Popular বা Peoples’ Sovereignty) প্রতিষ্ঠা  এবং বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার দায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়কে ধারণ এবং তাকে গাঠনিক রূপ দেবার কর্তব্য। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে  জনগণের যে  গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) ঐতিহাসিক ভাবে তৈরি ও হাজির হয়েছে তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করাই আমাদের কাজ।

আসিফ নজরুল কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন? তিনি সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামানকে বিভ্রান্ত ও ভুল পথে পরিচালিত করেছিলেন কেন? পুরা সেনাবাহিনী তো তখন জনগণের পক্ষে ছিল। এখন তিনি নিজের দায় অস্বীকার করে দোষ অন্যদের ঘাড়ে চাপাতে চান কেন? কেন তাঁর অজ্ঞতা, মূর্খতা এবং দায়িত্বহীনতার দায় এখন সেনা প্রধান নেবেন? গণ সার্বভৌমত্বের রাজনৈতিক ও আইনী যুক্তি তো সেনা প্রধানের জানার কথা না। সেটা আসিফ নজরুলেরই জানার কথা। কোন বিদেশী শক্তিরও চাপ ছিল না।

৩. তাহলে দেখা যাচ্ছে স্রেফ ক্ষমতার লোভে আসিফ নজরুল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে গণ অভ্যুত্থানকে বিসর্জন দিয়ে সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি হবার জন্যই ভুল পথে বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছেন। এই দায় একান্তই আসিফ নজরুলের। এই দায় আর কারো না।
এখন আসিফ নজরুল বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরাও উপস্থিত ছিলেন। তার মানে তিনি এখন তাদেরকেও তাঁর দোষের দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছেন। দাবি করছেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট  রাষ্ট্র ব্যবস্থার বা সংবিধানের অধীনে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠনে তাদেরও সায় ছিল। তাই কি আসলে? মাহফুজ, নাহিদ, আসিফ? কিন্তু কেউ না বলুক, তিনি শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল করবার কথা বললেন না কেন?  কেন তিনি গণ সার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) প্রশ্ন তুললেন না। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানও যে ধারণা মানে বা অন্তত স্বীকার করে। এখন আবার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আসিফ নজরুল  ‘বিপ্লব বিপ্লব’ বকোয়াজি শুরু করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন বটে, কিন্তু আমরা তো একবারও বিপ্লবের কথা বলি নি?  আমরা সব সময়ই গণ সার্বভৌমত্বের কথা বলে আসছি। আসিফ নজরুলের কাছ থেকেই আইন ও রাজনীতির সম্বন্ধ বিচার বা পর্যালোচনা সবাই আশা করেছিল। তিনি আমাদের আশা ভঙ্গ করেছেন।

৪. শুধু তাই নয়, “কেউ কেউ বলেন কেন শহীদ মিনারে শপথ নিলাম না, কেন বিপ্লবী সরকার হলো না, কেন সাংবিধানিক পথে গেলাম—এসব উল্লেখ করে আসিফ নজরুল কটাক্ষ করে বলেন, ‘এখন আপনি দেখবেন, কোনো কোনো মানুষ, তাঁরা পৃথিবীর সবকিছু জানেন। তাঁদের একজন সম্পর্কে মনির হায়দার বললেন, আসিফ ভাই, মনে হয় তাঁকে “জাতির পিতা” না বানিয়ে দেওয়া পর্যন্ত থামবে না। অথবা তাঁকে “জাতির পিতা” বানিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ যে খানে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের সময় পরস্পরকে বোঝা এবং চিন্তার পার্থক্য কাটিয়ে তোলা প্রধান কাজ, তখন এই ধরণের অর্বাচীন কটাক্ষ এবং তামাশা আরও বিভেদ সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য এই ধরণের অহংকারি মন্তব্য ক্ষতিকর।

৫. ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা: আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় আইন উপদেষ্টা ভুলের দায় থেকে বাঁচবার জন্য এই ধরণের মিথ্যা সাফাই গেয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলা একাডেমিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদর্শ ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান ব্রেইন যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। চুপ্পুর অপসারণ এবং হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিলের দাবি জোরদার হয়ে ওঠায় এটা ছিল আইন ও তথাকথিত সংবিধানের অজুহাতে যারা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে চায় এবং বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে চায় নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে সাফাই গাইবার অনুষ্ঠান।

৬. ‘বিপ্লব’ কথাটা সাধারণত বলশেভিক কিম্বা চিনা বিপ্লবের ‘পারাডাইম’ হিশাবে ব্যবহার হয়। বিভ্রান্তি এড়াবার জন্য ‘বিপ্লব’ বর্গটি এড়ানো ভাল। তাছাড়া জুলাইইয়ের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের জনগন বলশেভিক বা চিনা ধাঁচের ‘বিপ্লব’ করে নি।  সেটা গণ অভ্যুত্থানের সেটা উদ্দেশ্যও ছিল না। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশের জনগণ চেয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে নতুন ভাবে ‘গঠন’ (Constitute) করা – অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ। জনগণ নিজেরা নিজেদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে যা তাদের ‘অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ হিশাবে প্রতিষ্ঠিত হবে — এটাই জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সারকথা। একেই বলা হয় গণ সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। এমনকি বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ‘প্রজাতন্ত্র’ অধ্যায় গণসার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। দেখুন, প্রস্তাবনা এবং অনুচ্ছেদ ৭(২)।  স্বীকার করলেও মূল সংবিধান গণ সার্বভৌমত্বের বিরোধী অতএব  স্ববিরোধী। এই সকল বিষয় বিবেচনার দাবি না করে আসিফ নজরুল কেন সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার কায়েম করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই কায়েম করলেন?

৭. সেনাপ্রধানের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় রাজনৈতিক দল উপস্থিত ছিল। থাকতেই পারে। কিন্তু সেনাপ্রধানকে আইনী পরামর্শ আসিফ নজরুলই দিয়েছেন। তিনি তারই ফলশ্রুতিতে আইন উপদেষ্টাও হয়েছেন। সাংবিধানিক পথে যাত্রা ভুল হলে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে সেই ভুল আবার এখন শোধরাতে পারি। সেই পথ এখনও খোলা রয়েছে। কিন্তু আসিফ নজরুলের ফাঁপা ও অন্যায় দাবি আমাদের পরস্পরকে বোঝার এবং বাংলাদেশের বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না। বরং আরও জটিল হবে। তিনি বিভেদ ও বিপদ  আরও বাড়িয়ে তুলছেন।

৮. আসিফ নজরুলের আলোচনায় সেনাবাহিনী ও সেনা প্রধানের প্রতি অকারণ কটাক্ষ রয়েছে। সেনাবাহিনী তাঁকে ডাকলেই মেরে ফেলবে এই বক্তব্য সেনাবাহিনী – বিশেষত সেনা প্রধানের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই নাগরিক হিশাবে সৈনিকদেরও ভূমিকা আছে এবং থাকবে। সাধারণ সৈনিকেরা গুলি করতে অস্বীকার করায় গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতার মুখে শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালাতে বাধ্য হয়েছে। জাতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। রাজনৈতিক দল জনগণের খণ্ড খণ্ড অংশের প্রতিনিধি। আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক দলের বাইরে নাগরিক হিশাবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতজীবী শ্রেণীসহ সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের কথা মনে রাখতে হবে।। জনগণের কাতারে সৈনিকেরাও আছেন।

৯. বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আসিফ নজরুলের ফাঁপা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় এই দায় আসলে একান্তই তাঁর একার। এতো আত্মত্যাগ ও রক্তপাতের পর আমরা পেলাম সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার? এর ব্যাখ্যা আসিফ নজরুল কিভাবে দেবেন? এটাই যে হচ্ছে সেটা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। তিনি কর্ণপাত করেন নি।

পরিশেষে তিনি লেখেন, ‘আসিফ নজরুলের এই সাফাই আমরা তাই প্রত্যখান করতে বাধ্য হচ্ছি। গণঅভ্যুত্থানকে যারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনস্থ করেছেন এবং দাবি করছেন ‘সাংবিধানিক ভাবে যাওয়া দোষের ব্যাপার নয়’, তারা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছেন। তাঁরা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োজিত ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্ট চুপ্পুর অধীনে উপদেষ্টাদের শপথ নিতে বাধ্য করেছে, সেই ভুল হতেই পারে। আমরা মেনে নিয়েছি। কারন শোধরাবার পথ বন্ধ হয়ে যায় নি। কিন্তু নির্লজ্জ সাফাই গাওয়ার কোন যুক্তি নাই। বলা উচিত ছিল, আমরা ভুল করেছি, কিন্তু শোধরাবার সুযোগ শেষ হয়ে যায় নি। আসুন সবাই মিলে শোধরাই এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন করি। সংশোধনের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখুন।

আসিফ নজরুল, প্লিজ, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই এখনকার কাজ। নিজের দোষ ঢাকবার চেষ্টা করবেন না। ভুল আমরা যে কেউ করতেই পারি,কিন্তু যখন নিজের দায় অস্বীকার করেন, তখন সেটা মেনে নেওয়া যায় না।’